ইস্টার্ন টাইমস ,আগরতলা: ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব সংবাদ মাধ্যমের একাংশকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়ার পর থেকেই রাজ্য জুড়ে একের পর এক ছোটবড় হামলার ঘটনা ঘটছে সাংবাদিকদের উপর| ছোটখাটো হুমকি আর নিগ্রহের ঘটনা সেভাবে সামনে আসছে না| সাংবাদিকরাই সেগুলো প্রকাশ করতে বিব্রত বোধ করছেন| কিন্তু ইতোমধ্যেই তিনটি বড়সড় নিগ্রহের ঘটনাও ঘটে গেছে| যাতে আহত হয়েছেন চারজন |
কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের প্রচারকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ করে হুমকি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী| দক্ষিণ জেলার সাব্রুমে স্পেশাল ইকোনমিক জোনের উদ্বোধন করতে গিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজ্য সরকার কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে| সবকিছু ঠিকঠাক আছে| কিন্তু একাংশ সংবাদ মাধ্যম নাকি অতি উৎসাহী হয়ে উল্টাপাল্টা লিখে চলেছে| এদেরকে মানুষ ক্ষমা করবে না| ইতিহাস সাক্ষী, মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবও এদেরকে ছাড়বেন না |
সংবাদ মাধ্যমে রাজ্য সরকারের কোভিড চিকিৎসা নিয়ে লেখা হচ্ছে, খবর হচ্ছে কয়েকদিন থেকেই | কারণ উত্তর-পূর্বের রাজ্য গুলোর মধ্যে ত্রিপুরাতেই মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি | প্রতিটি কোভিড সেন্টারে অব্যবস্থার অভিযোগ| এমনকি রাজ্যের প্রধান হাসপাতাল জিবি হাসপাতালে অক্সিজেনের সমস্যা দেখা দেওয়ায় প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে গিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে রাতের বেলা| পরিস্থিতি দেখে আক্রান্তের স্বজনরা জোর করে হাসপাতাল থেকে রোগীকে বাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছেন| অথচ সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সবকিছু ঠিক আছে | কোনো সমস্যা নেই| আর যারাই বাস্তব অবস্থা নিয়ে মুখ খোলার চেষ্টা করছেন, তাদেরকে চক্রান্তকারী বলে অভিযুক্ত করে চলেছে প্রশাসন | মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই রয়েছে স্বাস্থ্য দফতরও|
অথচ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে যে সরকারের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে, সেটা আদালতের ভূমিকাতেও প্রকাশ পেয়েছে| ত্রিপুরা হাইকোর্ট সম্প্রতি এনিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে জবাব চেয়েছে| করোনা মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা প্রশ্ন চিহ্নের সামনে এসে যাওয়ায় ‘সুয়োমোটো’ কেস অর্থাৎ নিজে থেকেই মামলা নিয়েছে |
এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনকে ঘিরে সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিলে সাংবাদিক মহলে তো বটেই রাজ্য জুড়েই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়| আর শাসক দলের উগ্র সমর্থকদের একাংশ, বিশেষ করে যারা বিভিন্ন দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, যাদের কীর্তি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে বা প্রকাশ পাওয়ার আশংকা রয়েছে, তারা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রচণ্ড উদ্দীপিত হয়েছে| বিনা কারণে এখন তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে সাংবাদিকদের উপর | যে কারণে সাংবাদিকদের উপর প্রতিটি হামলার পেছনে শাসক বিজেপি দলেরই কর্মীদের নাম উঠে আসছে |
এই প্রেক্ষাপটে পরাশর বিশ্বাস নামে একজন সংবাদ প্রতিনিধি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট দেন | তিনি আগরতলা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার আমবাসা মহকুমার সংবাদ প্রতিনিধি | তিনিও কোভিড আক্রান্ত ছিলেন| তার চিকিৎসার পরিকাঠামো নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি |
এই অবস্থায় সংবাদ মাধ্যমকে মুখ্যমন্ত্রী এভাবে প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়ায় তিনি তার পোস্টে মুখ্যমন্ত্রীকে এ ধরনের হুমকি দেওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন| সেদিনই পরাশর বিশ্বাস কোভিড সেন্টার থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন| সঙ্গে সঙ্গেই একদল দুর্বৃত্ত তার বাড়িতে ঢুকে তাকে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করে| এলাকার মানুষ ছুটে এলে পালিয়ে যায় তারা| পরে পুলিশ এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়| এই ঘটনা দিয়ে শুরু |
তারপর তেলিয়ামুরায় ২৩ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন সাংবাদিক বিশ্বজিত রায়| তাকে নিগ্রহের পাশাপাশি ক্যামেরা ছিনিয়ে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করা হয় |
তৃতীয় আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ জেলার বিলোনিয়ায়| কৃষিবিলের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বামেদের প্রতিবাদ কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে বিলোনিয়ায়ও চলছিল মিছিল | সেখানে হামলা চালাতে গিয়েও জমায়েত বড় দেখে ভয় পেয়ে চলে যায় বিজেপি দলের কর্মীরা | তারা তখন বাম সমর্থক এক ব্যক্তির কাপড়ের দোকানে গিয়ে হামলা চালায়| সেই ঘটনা শুনে খবর সংগ্রহের জন্য সেখানে পৌঁছান সমীর দেবনাথ ও সুমন নাগ নামে দুই সাংবাদিক| সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর হামলা চালায় বিজেপি কর্মীরা| দুই সাংবাদিকই প্রচণ্ডভাবে আহত হয়েছেন|
এছাড়া ছোটখাটো তিরস্কার আর হুমকি দেওয়া চলছেই| পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, সাংবাদিকরা এখন খবর করতে ভয় পাচ্ছেন | বিজেপি কর্মীরা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছে যে, সাংবাদিক শুনলেই কিছু বিজেপি কর্মী তেরেফুরে আসে| অথচ এমন পরিস্থিতি আগে কখনও কোনদিন ত্রিপুরায় ছিল না |
এইসব ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও আগরতলা প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানো হয়েছে | থানায় মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি | সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন মুখ্যমন্ত্রীকে এক সপ্তাহের মধ্যে তার বক্তব্য ফিরিয়ে নিয়ে পরিবেশ ঠিক করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে| এমনকি রাজ্যপালের দ্বারস্থও হয়েছেন সাংবাদিকরা | কিন্তু পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না | অনিশ্চয়তায় ভুগছেন সাংবাদিকরা|
