বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
দূর্গা পুজো এখন আর কাশফুলের দোলায় আলপথ বেয়ে উমার বাপের বাড়ি আসা নয়। গিরিরাজ কন্যা এখন ঠাট বাটে রীতিমত কর্পোরেট। বানিজ্যিক রাংতায় মোড়া তার বাপের বাড়ির চারদিন।
গত বছর কলকাতার তিনটি বড় পুজোর সঙ্গে এক বেসরকারি সংস্থার চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী ওয়েব সাইটে লগ ইন করে ভার্চুয়্যালি দর্শন এবং পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল আর অনলাইনে পেমেন্ট করলে প্রনামী এবং ফল, মিষ্টি, শাড়ি, আলতা ও সিঁদুর সহ ডালার ব্যবস্থা ও ছিল।
দেশের শুধু মাত্র বড় বড় মন্দির যেমন তিরুপতি ও সিদ্ধি বিনায়ক মন্দিরে এই ব্যবস্থা রয়েছে।দু হাজার পনেরো সালে বণিক সংগঠন অ্যাসোচেম দুর্গা পুজো নিয়ে তাদের সমীক্ষার রিপোর্টে বলেছিল সেই বছর পুজোয় আর্থিক লেনদেন গিয়ে দাঁড়াবে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়াও পরবর্তী বছর গুলোতে ৩৫% হারে গ্রোথ রেট-এর পূর্বাভাস ছিল সেই সমীক্ষায়। সেই হিসেবে গত বছর পুজোয় আর্থিক লেনদেনের হিসাব গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১.৫০০০০০ কোটি টাকা। এ বছর অতিমারি কাঁটা হয়ে না দাঁড়ালে আর্থিক লেনদেনের অঙ্ক পৌঁছত ২,০০০০০ কোটি টাকা। যা পশ্চিম বঙ্গের বাজেটের কয়েক গুন বেশি।
দুর্গাপুজোয় গত কয়েক বছরে এই পরিবর্তন টা এসেছে। কলকাতার বড় বড় পুজোর বাজেট হাজার লক্ষ পেরিয়ে কোটিতে পৌঁছেছে। কর্পোরেট ফান্ডিং এবং বিজ্ঞাপনের অর্থে ফুলে ফেঁপে উঠেছে বাজেট। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০,০০০ পুজো হয়। তার মধ্যে সাড়ে তিন হাজার পুজো কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায়। খাস কলকাতায় চারশো টি পুজো হয়। ফলে পুজোর বানিজ্যিক সম্ভাবনা চিনে নিয়েছে জহুরিরা।
পুজোয় বহু প্রতিমা শিল্পী, ঢাকি, ছোট দোকানদার সহ আরো অনেকের সারা বছরের উপার্জন হয়ে যায়। এ বছর অতিমারির গ্রাসে পুজোয় শঙ্কার ছায়া। অতিমারির জেরে টোকিও অলিম্পিক, চ্যাম্পিয়নস লিগ সহ বহু দেশে ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসব বাতিল হয়েছে।
চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ বলছেন, চিনে কভিডকে অগ্রাহ্য করে নববর্ষ পালনের ফলেই সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। জার্মানি তে অক্টোবর ফেস্ট এক বিশাল উৎসব। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সেই উৎসব বাতিল হয়েছে। এর ফলে সে দেশে অর্থনীতিবিদরা বলছেন বিপুল আর্থিক লোকসান হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে শুধু নয়, গোটা দেশের আর্থিক পরিস্থিতি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে পুজোয় এবার কর্পোরেট ফান্ডিং প্রায় নেই। সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতা তলানিতে, ফলে কেনাকাটার পাশাপাশি হোটেল, রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়াতেও কোপ পড়বে। রিঅপেনিং-এ পর্যটনে আগল খুললে মানুষের বেড়াতে যাওয়ার সামর্থ প্রায় নেই।
এই কারণে অ্যাসোচাম-এর গ্রোথ রেটের পূর্বাভাস স্পর্শ করা তো দূরের কথা, গ্রাফ কতটা নিম্নমুখী হবে তা ভেবে আতঙ্কিত অর্থনীতিবিদরা। তাই দুর্গাপুজো এখন এক দিয়ে আর্থিক কর্মকাণ্ড, অন্য দিকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখার চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে।’মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’– শঙ্খ ঘোষের এই কবিতার লাইনটি সচরাচর বাংলায় পুজোর দিনগুলোর জন্য প্রযোজ্য। কর্পোরট পুজোয় দেবীর মুখ থেকেও বেশি দামী হয়ে ওঠে বিজ্ঞাপনে মোড়া সাদা চকচকে ত্বকগুলো। এবারের পুজো দেখে হয়তো কবি লিখবেন– ‘মুখ ঢেকে যায় আতঙ্কে’।
মন্বন্তর, প্রাকৃতিক বিপর্যয় , দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ও দুর্গাপুজো হয়েছে কিন্তু অতিমারি যে বিপদ নিয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে পুজো নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টে পুজো বন্ধের আবেদন জানিয়ে জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন পুজো যত না আনন্দের তার চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্কের। রাজ্যের করোনা
পরিস্থিতিতে প্রায় কোন হাসপাতালেই তিল ধারণের জায়গা নেই। রাজ্যে সাড়ে তিন হাজারের মত ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেড রয়েছে। এখন যদি আরো হাজার খানেক বেড বাড়ানো যায় তাতেও সামাল দেওয়া যাবে না। কারণ পুজোয় মানুষের ঢল নামে। বর্তমানের কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা যা তার পাঁচ গুন বাড়লে আর বেড দেওয়া যাবে না।
চিকিৎসকরা বলছেন পুজো মণ্ডপের মধ্যে বিপুল ভিড়, চারপাশ বন্ধ, তুমুল কোলাহল, এ সবই করনার ভারি পছন্দ। বদ্ধ জায়গায় ভিড়ের মুখ থেকে যে অ্যারোসল (aerosol) বেরোবে তা মাস্কও আটকাতে পারবে না। এই অবস্থা হলে পুজো মণ্ডপগুলি সুপার স্প্রেডার হয়ে দাঁড়াবে। চিকিৎসকদের মতে এর থেকে বাঁচার উপায় হল ভিড় করা যাবে না মোটেই।