
তাপস দাশ
২৩ নভেম্বর দুপুরে বাংলা সংবাদমাধ্যমের নজর চলে গেল তৃণমূল ভবনে। তারপর থেকে ব্রেকিং আর হেডলাইন। আইমিমের এক নেতা তৃণমূলে যোগ দিলেন। তিনি বড় নেতা ছিলেন না কি ছিলেন না, সে নিয়েও চাপানউতোর শুরু হয়ে গেল।
৬ মাস পর বাংলায় ভোট। ভোটের ইস্যু অবশ্য ঠিক হয়েই আছে। বাংলার ভোট হবে ধর্মের ভিত্তিতে। পুরোহিত ভাতা না ইমাম ভাতা, কোনটা বেশি ক্ষতিকর, কে কাকে বেশি তোল্লাই দেয়, এসবের তুল্যমূল্য টানাপোড়েন, দাবি ও পাল্টা দাবি চলতে থাকবে। আর যা কিছু, ধরা যাক দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ, স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা, এসব থাকবে না, এমন নয়, কিন্তু সেগুলি এবং ও ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে। দেশের ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থী দলটির সাফল্য এইখানেই যে তারা রাজনৈতিক আলোচনার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে পেরেছে সম্পূর্ণত, তাদের পথটিই এখন প্রায় সব রাজনৈতিক দলের কাছেই একমাত্র স্বীকৃত পথ। অন্য পথে আর কেউ চলতে চাইছেন না।
বিজেপির তরফে এসব কাজকর্ম অনেক সুনিপুণ, সুচারুভাবে করা হয়ে গিয়েছে। বিজেপিবিরোধী শক্তিরা ওই পথরেখাই মূলত অনুসরণ করে চলেছেন। তার ব্যতিক্রম যে একেবারে নেই, তেমন নয়।
কিন্তু সংখ্যাগত বিচারে সে ব্যতিক্রমের সংখ্যা নগণ্য। তবে ব্যতিক্রমীদের সাফল্যের হার কিন্তু হেলাফেলার নয়।
দিল্লি বিধানসভা ভোটের অন্যতম ইস্যু ছিল বিদ্যুতের দাম। প্রতিশ্রুতি ছিল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে পাবেন নাগরিকরা। সে প্রতিশ্রুতি পূরণ করাও হয়েছিল।
অবশ্য আপের মুখ তথা আপ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ভোটজয়ের পর ধর্মপথে গিয়ে হনুমানজিউর আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী ভোটের পথ অবলম্বন করেননি।
বিহারের ভোটে বামপন্থীদের ভাল ফলের পিছনেও এই বিষয়টিই কাজ করেছে। তাঁরা জনগণের দৈনন্দিন বেঁচে থাকা ও রুজিরোজগারের বিষয়টিকে রাজনৈতিক আলোচনায় নিয়ে আসেন, সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু, বলিউডের নেপোটিজম বা বিহারি সেনার সীমান্তে মৃত্যুর মত আবোদা বিষয়গুলি তাঁরা এড়িয়ে গিয়েছেন।
অর্থাৎ, বিজেপির ঠিক করে দেওয়া নিয়ম মেনে ভোটের ময়দানে না-নামার সুফল ভোগ করেছেন এঁরা।
অন্যদিকে বাংলা বরাবরই রাজনীতি সচেতন বলে খ্যাত। বাঙালিদের বড় অংশ এ নিয়ে আত্মম্ভরীও। বিহারবাসীকে তাঁরা অশিক্ষিত খোট্টা ভাবেন, দিল্লিবাসীদের প্রতিও তাঁরা অনুরক্ত নন।
কিন্তু এখন বাংলার রাজনীতি গোবলয়ের ভাবনাচ্ছন্ন, গোবলয়ের সম্প্রসারিত অংশ হয়ে ওঠার পানেই তার দৃষ্টি। এর একটা বড় কারণ যদি দিলীপ ঘোষের দলবল ও আইটি সেল হয়, আর একটা অন্যতম কারণ বিজেপিবিরোধীদের আত্মবিশ্বাসের অভাব। বাংলার মূল বিজেপিবিরোধী শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস কোনও নির্দিষ্ট ধরনের আদর্শ-আবদ্ধ নয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-নির্ভর এই দলটি মূলত প্রতিক্রিয়ার রাজনীতিই করে থাকে। চালু কোনও অবস্থার বিপ্রতীপে নিজস্ব ক্রিয়াশীলতা নির্ণয় তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতার বাইরে।
এ ছাড়া এখানে অন্য যে দুর্বল শক্তি, সেই সিপিএম তথা ফ্রন্টের বামেরা এসব খুব জরুরি প্রশ্ন মনে করে বটে, কিন্তু তাদের সাধ্য যে সীমিত, সে কথা সহজেই বোঝা যায়, বোঝা যা যায় না, সে তাঁদের সাধের কথা।
নেতাদের ভাষণের বর্শামুখ থাকে তৃণমূলের দিকে, শেষের দিকে বা গোড়ার দিকে পাখি পড়ার মত গেরুয়াবিরোধিতা করে যান তাঁরা। এ অবস্থায় বিজেপির ধর্মলাইন অবিকল্প হয়ে পড়ে, পড়ছেও।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে আস্থা রাখছেন। ফলে তিনি কখনও ইমাম ভাতা, আবার তার প্রতিক্রিয়ায় পুরোহিত ভাতা দিচ্ছেন। কিন্তু এতে চিঁড়ে শেষ পর্যন্ত বারবার ভেজে না।
এই কারণেই যতবার মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করেন, যতবার জেলাসফরে যান, এই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির দুর্বলতা চোখে পড়ে।
এই নিবন্ধ লেখার সময়েই জেলাসফররত মুখ্যমন্ত্রী ছাতরা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে ধমক দিয়েছেন, দাও দাও করার জন্য। জানিয়ে দিয়েছেন, আর কিছু তিনি দিতে পারবেন না।
এবং বলেও ফেলেছেন, বাকি দেওয়া-থোওয়া ভোটের পর। এ একটা স্পষ্ট হিসেবের খেলা। তোমরা আমাকে জিতিয়ে দাও, আমি তোমাদের পাইয়ে দেব।
বর্তমানের রিয়েলপলিটিকে এমনটাই হবে, প্রাজ্ঞজনেরা হয়ত তেমনটাই বলবেন। কিন্তু এও ঘটনা, যে এ পথ কেন্দ্রাসীন সরকারের বিরোধী কোনও অঙ্গরাজ্যের সরকার অবলম্বন করলে তার সীমাবদ্ধতা ধরা পড়বেই।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবারের সময়সীমা শেষ হতে চলেছে।
তৃণমূল যদি ফের একবার রাজ্যের মসনদে টিকে যায়, বিজেপির চেনানো ধর্মপথের বাইরে অপর কোনও পথ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভাবতে হবে, আর মমতা সরকারকে ভাবতে হবে পাইয়ে দেওয়ার বাইরে কোনও অন্য পথ।
ওয়েইসির দলের নেতা ভাঙানোর সরল পথে বেশিদিন চলতে পারে না, এ কথা মমতা নিজেও সম্ভবত উপলব্ধি করতে পারেন।
