ইস্টার্ন টাইমস, বিশেষ সংবাদদাতা, ঢাকা, ৪ নভেম্বর: আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল নাইনটিনের’ বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণœ করছে এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের কার্যকারিতা ও নাগরিক অধিকারের প্রসারে বাধা হিসেবে কাজ করছে।
বুধবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতা অবসানের আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে একটি সভায় এ কথা বলেন তিনি।
ঢাকাস্থ কানাডিয়ান হাইকমিশন এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনের সহযোগিতায় আর্টিকেল নাইনটিন একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করে। এটি মূলত আগামি ১৬ নভেম্বর ২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় গ্লোবাল কনফারেন্স অন মিডিয়া ফ্রিডম ২০২০-কে সামনে রেখে আয়োজিত।
‘ডিফেন্ডিং মিডিয়া ফ্রিডম ফর ডেমোক্রেসি এন্ড সিটিজেনস রাইটস ইন বাংলাদেশ’ (গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা) শীর্ষক এই অনলাইন সভায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ঝুঁকি মোকাবেলায় করণীয় এবং গণতন্ত্র নিশ্চিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা বিষয়ক বিভিন্ন দিক উঠে আসে।
সভায় সাংবাদিক, মিডিয়া সংগঠন, আন্তর্জাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক মিশন ও দূতাবাস, শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ, ব্লগার, মানবাধিকার কর্মীসহ গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, তৃণমূল সাংবাদিক, তরুণ নেতৃত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
এই সভায় বাংলাদেশসহ বিশ্বেজুড়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের সুরক্ষা, নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্যের অধিকার খর্ব হওয়ার প্রবণতার বিষয়টি প্রাধান্য পায়।
আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশে একটি মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, গণমাধ্যমের সুরক্ষা ও নাগরিক অধিকারের জন্য স্বীকৃত সাধারণ মান হিসেবে নাগরিক সমাজ, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে ‘ঢাকা ঘোষণাপত্রের’ (ঢাকা ডিক্লারেশন) একটি খসড়া তৈরি করে যেখানে পরামর্শ সভার বিভিন্ন বিষয় ও মতামতগুলো সন্নিবেশিত করা হয়।
ঢাকা ঘোষণাপত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং তথ্যের অধিকার, লিঙ্গ ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা এবং নাগরিক পরিসর নিশ্চিতে তরুণ নেতৃত্বকে উৎসাহিত করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়।
চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রটি ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সুপারিশ হিসেবে অনুষ্ঠিতব্য গ্লোবাল কনফারেন্স অন মিডিয়া ফ্রিডম’-এর দ্বিতীয় আয়োজনে উপস্থাপিত হবে।
কানাডিয়ান হাই কমিশনার বেনোয়া প্রোফোঁতেইন ও ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসনের স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সলের সঞ্চালনায় এতে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এস্ট্রাপ পিটারসেন, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এস্পেন রিকটার-সোভেনডেন, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার জেরেমি ব্রিউয়ার, বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাংলাদেশে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দ্রা বারগ ভন লিনডে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে কানাডিয়ান হাই কমিশনার বেনোয়া প্রোফোঁতেইন বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও ভয় দেখানোসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
এজন্য অফলাইনে যেসব স্বীকৃত নাগরিক অধিকার আছে; অনলাইনেও সুরক্ষার জন্যে একই ধরনের অধিকারের স্বীকৃতি জরুরি। তথ্যভিত্তিক সঠিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের জন্য একটি শক্তিশালী ও কার্যকর গণমাধ্যম ব্যবস্থা এক্ষেত্রে অপরিহার্য।’
ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, ‘সাংবাদিকরা মুক্ত গণমাধ্যমের অংশ হিসাবে গণতন্ত্র নিশ্চিতে এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর সময়ে মানুষের জীবন রক্ষায় তথ্য সরবরাহ করে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশ সরকার সর্বত্র সাংবাদিক এবং আর্টিকেল নাইনটিনসহ সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা সংস্থাগুলোকে সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকের জন্য ’সুরক্ষা ধারণার’ বিস্তার ও প্রসারে দীর্ঘমেয়াদি এডভোকেসি ক্যাম্পেইন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতি তার দেশের সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, ‘সাংবাদিক ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম আমাদের সত্য জানতে সহায়তা করে।
এটি কখনও কখনও অপ্রীতিকর এবং মেনে নেয়া কঠিন। তবে এটি আমাদের সমাজকে আরও উন্নত করে। এটি আমাদের আরও শক্তিশালী করে তোলে। স্বাধীন গণমাধ্যম অসহায়ের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে, অবিচার প্রকাশ করে এবং নেতৃত্বের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।’
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো বলেন করোনার সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং ধর্ষণের মত অপ-সংস্কৃতি রোধ করে মানবাধিকার রক্ষায় গণমাধ্যম মূল ভূমিকা পালন করে।
গণমাধ্যম এসব কিছুর অবসানে ব্যক্তিগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সচেতনতা তৈরি করে।
সংবেদনশীল প্রতিবেদন তৈরির সময় সমস্যার খন্ডিত অংশের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। এভাবে ধর্ষণের মত মারাত্মক ও গভীর সামাজিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।”
অনুষ্ঠানে আলোচকরা বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। এটি মানবাধিকার সুরক্ষা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে জরুরি। বিকৃত তথ্যের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমই হলো মূল হাতিয়ার। অথচ করোনাকালে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
এটা এমন এক সময়, যখন তথ্যের অবাধ প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবন রক্ষাকারী তথ্য উপস্থাপন অত্যাবশ্যক। তাই মুক্ত গণমাধ্যম নিশ্চিতকরণ, সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও মানবাধিকার নীতিমালা অনুসারে সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আরও দৃঢ় অঙ্গীকার প্রয়োজন।
