
তাপস দাশ
কৃষক সংগঠনগুলির নেতাদের সঙ্গে সরকারের ফের একদফা বৈঠক হয়ে গিয়েছে বৃহস্পতিবার। সে বৈঠকের পরেও নিজেদের দাবি সূচ্যগ্র ছাড়তে রাজি হননি বিক্ষোভকারীরা। সহায়ক মূল্যের ব্যাপারে পুরনো পদ্ধতি চালু থাকবে, এমন প্রস্তাবের পরেও তাঁরা বলেছেন, বিশেষ অধিবেশন ডেকে তিন কৃষি আইন বাতিল করতে হবে।
এদিকে সরকারের উপর চাপ বাড়াতে আরও কৃষক জমায়েত হচ্ছেন দিল্লির রাস্তায়। স্পষ্ট যে অভূতপূর্ব ভাবেই সরকারের সঙ্গে কোনওরকম সহযোগিতা করতে রাজি নন কৃষকরা, অন্তত যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁদের দাবি মিটছে। এরকম ঘটনা এই সরকারের কাছে অভূতপূর্ব, বিশেষ করে ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর বর্বর সংখ্যাধিক্যের জোরে কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই এমন সব বিল পাশ করিয়ে আইনে পরিণত করা হচ্ছে, যা ভারতের বিভিন্ন কাঠামোকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম। গায়ের জোরেই পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে ৩৭০ ধারা রদের মত বিষয়।
সাংবিধানিক কাঠামোটিকে ভেঙে নয়া সংবিধান রচনার পথ তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছে, কিন্তু কৃষকশক্তির কাছে যে এতটা বেগ পেতে হবে, তা ঠাহর করতে পারেনি মোদী সরকার।
বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফার আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে বিজ্ঞানভবনে। বৈঠক চলেছিল প্রায় সাত ঘন্টা। বৈঠক চলাকালীন মধ্যাহ্নভোজের সময় এসে পড়ে। যে কোনও ধরনের সরকারি আলোচনায়, বৈঠকের আহ্বায়কপক্ষ খাদ্য-পানীয়ের বন্দোবস্ত করে থাকে, তেমনটাই চালু বিধি। এবারও তেমন বন্দোবস্ত ছিল।
কিন্তু বিধি মতে যে তাঁরা চলবেন না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই কৃষকশক্তি। তাঁরা জানিয়ে দেন, নিজেদের খাবারের বন্দোবস্ত তাঁরা নিজেরাই করেছেন। অ্যাম্বুল্যান্সে করে তাঁদের খাবার আসার সচিত্র সংবাদ সকলেরই দেখে ও পড়ে ফেলেছেন।
ঘটনা হল, প্রথম দিনের বৈঠকের সময়েও তাঁরা সরকার পক্ষের দেওয়া চা পান করেননি। সেদিন মনে হয়েছিল, এ এক ধরনের ক্রোধসঞ্জাত পদক্ষেপ।
দ্বিতীয় দিনের মধ্যাহ্নভোজের প্রত্যাখ্যান বুঝিয়ে দিল, এ পদক্ষেপ সুচিন্তিত।
কৃষক নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা অন্ন দিয়ে থাকেন, তাঁরা স্বনির্ভর। অপর পক্ষের সঙ্গে তাঁরা যখন যুযুধান, সে সময়ে অপর পক্ষের অন্ন গ্রহণ না করে, তাঁরা বার্তা দিলেন।
যে বার্তা ভারতের রাজনীতিতে অভূতপূর্ব। হাজারো-লাখো সাথী কৃষক, যাঁরা শীতের রাতে নিজেদের ক্রোধাগ্নিতে নিজেদের সেঁকে উত্তপ্ত রাথছেন, তাঁদের কাছে বার্তা গিয়েছে, সৌজন্য রাখতে গিয়ে নেতারা শত্রুপক্ষের সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপ করছেন না, এবং দূরত্ব বজায় রাখছেন। সরকার পক্ষের কাছে বার্তা গিয়েছে, এ বড় সহজ ঠাঁই নয়। আম জনতা, যাঁরা কৃষকও নন, নন সরকার পক্ষও, তাঁরাও বুঝেছেন, এবারে যা ঘটছে, তা খাস।
ভারতীয় রাজনীতিতে এমন ঘটনা বিরল। সৌজন্যের নৈশভোজ, চা- পার্টি, ইফতার বা হোলির অনুষ্ঠানে সকলে রাজনৈতিক দূরত্ব সত্ত্বেও মিলেমিশে যান। এমনকী সংসদীয় রাজনীতিতে এসবকে কেন্দ্র করে অনেক বরফও গলে।
কিন্তু এবারের ঘটনা তেমন নয়। এ প্রসঙ্গে স্মরণে আসতে পারে কয়েক বছর আগের এ রাজ্যের একটি ঘটনার কথা। রাজ্যে তখন পালাবদল হয়ে গিয়েছে।
এখন এই ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে, যে কথা প্রায় অসম্ভব মনে হবে, তেমনটা ঘটেছিল ২০১৪ সালে। লোকসভা নির্বাচন সদ্য ঘটে গিয়েছে তখন। সে সময়ে সারা রাজ্যে নিজের দলের কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, এমন অভিযোগ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সিপিআইএম নেতারা। তাঁদের অন্যতম ছিলেন বিমান বসু। মমতা তাঁকে আপ্যায়ন করেছিলেন ফিশ ফ্রাই, ক্রিম রোল, দার্জিলিং চা দিয়ে। বিমান বসুর অভিযোগপত্র মমতা গ্রহণ করেছিলেন, বিমান বসু গ্রহণ করেছিলেন মমতার আপ্যায়ন।
সে সময়ে ফিশ ফ্রাই নিয়ে বেশ কিছু মজাদার ছড়া-ছবি তৈরিও হয়েছিল। কিন্তু সকলেই মেনেও নিয়েছিলেন, রাজনীতিতে এমনটাই ঘটে থাকে।
দাবি-দাওয়া-অভিযোগ-বিরোধিতার পরেও এসব সৌজন্য চলে। চলছিলও তেমনটা। সেই চলমান ধারাটিকে ভেঙে দিল কৃষক আন্দোলন। কৃষক নেতারা দেখিয়ে দিলেন, যারা তাঁদের অন্ন কাড়তে চায়, সে পক্ষের অন্ন ও আপ্যায়ন না গ্রহণ করাও একটি মূর্ত রাজনীতি।
এবার থেকে তৈরি হল এক নতুন কষ্টিপাথর। নিশ্চিত, এ কষ্টিপাথরের উদাহরণ পরবর্তীকালে বিমান বসুর মত আরও অনেক রাজনীতিবিদকেই আপ্যায়ন গ্রহণের পদক্ষেপ করার আগে দু-এক মুহূর্ত ভাবিয়ে তুলবে।
