
পারিজাত সেনগুপ্ত
একসাথে ৫৫ টি জায়গায় ৩০০ জন সিবিআই অফিসারের অভিযান,একাধিক কেন্দ্রীয় অফিসে খানাতল্লাশি, অভিযান চলাকালীন ইসিএলের এক নিরাপত্তা আধিকারিকের মৃত্যু ( ধনঞ্জয় রায়,বয়স ৪৪,কুনস্তরিয়া কোলিয়ারি),তার আগে ইডির অভিযান, এলাকার একাধিক রাঘব বোয়াল কয়লা মাফিয়ার আত্মগোপন — খনি অঞ্চলে এখন বলিউডি চিত্রনাট্য মেনে যে নাটক চলছে তা দেখে বেজায় খুশি এখানকার মানুষেরা।
এই অভিযানে রাজনীতির উপাদানও কম নেই। সেন্ট্রাল এজেন্সিগুলির এহেন তৎপরতা বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ সফরের পর বিজেপির সাফল্য বলে দাবি করেছেন স্থানীয় সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়।আবার তৃণমূল কংগ্রেসের পশ্চিম বর্ধমান জেলা সভাপতি ও আসানসোলের মহানাগরিক জিতেন্দ্র তেওয়ারির মন্তব্য ইসিএলের আধিকারিক ও সিআইএসএফের মদত না থাকলে কয়লা মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য সম্ভব নয়।আর পূর্বতন শাসক ও বর্তমানে বিরোধী বামপন্থীরা বলছেন কেন্দ্র ও রাজ্যর দুই শাসক দলই অবৈধ কয়লা কারবারে যুক্ত।
খনি অঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতা অন্য। তারা বলছেন এসব কিছুই সাময়িক,নির্বাচন আসছে তাই নাটক জমেছে।
এর আগেও বহুবার এরকম হয়েছে, আবার সব ‘ সেট’ হয়ে যাবে।পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল ও দুর্গাপর মহকুমা, দামোদর নদী পেরিয়ে পুরুলিয়ার সাঁতুড়ি,বাঁকুড়ার শালতোড়া থেকে পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড এর ধানবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত কয়লাখনি অঞ্চল।লোকের কথায় কালো হীরের দেশ।
আর এই কয়লাকে ঘিরেই বৈধ- অবৈধ কারবার যার সঙ্গে জড়িত কোল মাফিয়া, পুলিশ, সরকারি কোল কোম্পানি সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার অফিসার, রাজনৈতিক নেতা মায় গরীব শ্রমজীবী মানুষ। এ এক সমান্তরাল অর্থনীতি,খনি অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন এমন এক গবেষকের মতে টাকার পরিমাণ নিদেন পক্ষে মাসে ৭০০ কোটি।
খনি অঞ্চলের বেআইনি কয়লা কারবারের গল্পটা বেশ খটোমটো। এর একদিকে আছে সরকারি কোল কোম্পানিগুলি যেমন ইসিএল ও বিসিসিএল যে কয়লা উত্তোলন করে তার চুরি।এটা ইসিএল এর নিজস্ব সিকিউরিটি প্রাইভেট এজেন্সি,সিআইএসএফ ও এক শ্রেণির অফিসারের যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব নয়।এই প্রতিবেদকের মতে এই চোরাই কয়লা বেআইনি কারবারের সামান্য অংশ মাত্র।
এর থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কয়লা খাদান।সাধারণভাবে ইসিএলের পরিত্যাক্ত খনি বা কয়লা আছে এমন সম্ভাব্য জমি চিহ্নিত করে কয়লা খোঁড়ার কাজ শুরু হয়।এগুলোকে খাদান বলে।
খাদানগুলো কয়েকজন মিলে চালায়,এখানকার লোকেদের ভাষায় সিন্ডিকেট। কয়লা খুঁড়ে তোলার জন্য গরীব মানুষদের দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে লাগানো হয়।বহু সময় কয়লা কাটতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়।অনেক লোক মারা না গেলে সিন্ডিকেট কিছু ক্ষতিপূরন দিয়ে মৃতের আত্মীয়দের মুখ বন্ধ করে দেয়। সেই কয়লা এবার সাইকেল বা ট্রাক্টর বাহনে কাছাকাছি কোন দাদার দায়িত্বে জমা হয়।তারপর ট্রাকে চেপে কয়লা পাড়ি দেয় ডানকুনি,কলকাতা,শিলিগুড়ি, বারাসত,ডায়মন্ডহারবার, এমনকি আসাম পর্যন্ত।
বেআইনি কয়লা ব্যবসার আলোচনায় একটা সোজা কথা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। সরকারি প্রশাসন, এজেন্সি ও রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থন ছাড়া এই ব্যবসা একদিনও চলা সম্ভব নয়।
যেমন এক ট্রাক বেআইনি কয়লা আসানসোল থেকে ডানকুনি যেতে নিদেন পক্ষে ৩০ টা থানা এলাকা পরে।তাহলে কয়লা পরিবহন হয় কি করে? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কয়লা কারবারি জানালেন ট্রাক ড্রাইভারের হাতে দেওয়া থাকে একটা কাগজ ( কারবারিরা একে বলে প্যাড,দুমাস অন্তর প্যাডের কাগজের রঙ পাল্টে যায়) যা দেখালে গন্তব্যে পৌঁছানোর ছাড়পত্র মেলে।
এই গোটা ব্যাপারটাতে পুলিশ, প্রশাসন,রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনি,বিভিন্ন অফিসাররা জড়িয়ে।আর মাঠে নেমে যারা কাজটা করে তারাই কোল মাফিয়া বলে পরিচিত হয়।১৯৯০ সাল থেকে এই ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে।এবার যেমন লালাজি( প্রকৃত নাম অনুপ মাজি,এর দুর্গাপূজার বাৎসরিক বাজেট ১ কোটি টাকা),অশোকজির নাম শোনা যাচ্ছে, বিগত সরকারের সময় শোনা যেত রাজু,কাজু,সুদেব,জয়দেবদের নাম।হিসাবটা পরিষ্কার।যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা সিংহভাগ পায়,তবে অন্যরাও বঞ্চিত হয় না।
আজ এই বেআইনি কয়লা সমান্তরাল অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে। একথা কারো অজানা নয় আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের হোটেল, রিসর্ট,আবাসন,হাসপাতাল, বাস পরিবহনে কয়লার টাকা ঢুকছে।আবার কয়লা কাটা,পরিবহন, নিয়ন্ত্রণে বহু মানুষ যুক্ত,এটাই তাদের কর্মসংস্থান।
আবার রাজনৈতিক দলগুলোর খরচের একটা বড়ো অংশ এখান থেকেই আসে।তাই অভিযান হবে, কিছু দিন কয়লা বন্ধ থাকবে, আবার কিছু দিন পর সব আগের মত হয়ে যাবে — এমনটাই মনে করছে এলাকার মানুষ ।
