তাপস দাশ
সাতদিন ধরে চলা মুম্বইয়ের সাহিত্য উৎসব শেষ হল রবিবার, ২২ নভেম্বর। এই উৎসবে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল নোয়াম চমস্কির। উৎসবের কিঞ্চিত সময় বরাদ্দ করা ছিল বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত নোয়াম চমস্কির জন্য। একা চমস্কির জন্য ঠিক নয়, কথা ছিল তাঁর নতুন বই Internationalism or Extinction নিয়ে তিনি কথা বলবেন সাংবাদিক বিজয় প্রসাদের সঙ্গে।
সবই ঠিকঠাক চলছিল। সমস্যার উদয় হয়, কিছু গোষ্ঠী চমস্কিকে একটি খোলা চিঠি লেখার পর।
ওই চিঠিতে তাঁকে জানান হয়, এই সাহিত্য উৎসবের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক টাটা গোষ্ঠী, যাদের ভূমিকা ও চমস্কির অবস্থান বিপরীত মেরুর।
তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর, ওড়িশার কলিঙ্গনগরে টাটার ভূমিকার কথাও। নোয়াম চমস্কির অন্যতম গুণ, তিনি প্রায় সব রকমের চিঠির উত্তর দেন।
এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি। চমস্কি জানিয়ে দিয়েছিলেন, টাটার কাজকর্ম সম্পর্কে তিনি অবহিত। তিনি স্পষ্ট ভাষায় নিজেদের পরিকল্পনার কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন।
বলেছিলেন, তাঁদের কথোপকথনের শুরুতেই বিজয় ও তিনি একটি বিবৃতি পাঠ করবেন, যে বিবৃতিতে টাটার মত কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলি, এবং নির্দিষ্টভাবে টাটা সম্পর্কেও তাঁদের মনোভাব স্পষ্ট করে বলা থাকবে।
এর পরেই উৎসব কর্তৃপক্ষ ‘অভূতপূর্ব পরিস্থিতি’-র ওজর দেখিয়ে চমস্কি-বিজয়ের কথোপকথনের কর্মসূচি বাদ দিয়ে দেন। চমস্কিদের কর্মসূচি বাতিল কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
টাটা ও বিজেপি সরকারের আঁতাত সর্বজনবিদিত। টাটা ভারতের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও তারা মুনাফার স্বার্থে যে কোনও সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে থাকে।
এ ব্যাপারে তাদের বাছবিচার নেই। কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের সঙ্গেও হাত মিলিয়ে চলত টাটারা। এ তাদের মুনাফাধর্মও বটে।
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার মানীর মান সর্বদা বজায় রেখেছে বা বিরোধীমত প্রকাশে বাধা দেয়নি, এমন কথা তাদের অত্যুগ্র সমর্থকও বলবেন না।
বরং তারা কথা না-বলতে-দেওয়ার সংস্কৃতিটিকে পরিপুষ্ট করেছেন।
অমর্ত্য সেন বা অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, নোবেল লরিয়েট হোন বা বলিউডের নায়িকা, যে কোনও বিরোধী স্বরকে তুবড়ে দিতে চাওয়া হয়েছে নির্লজ্জ অসভ্যতার মাধ্যমে। দিলীপ ঘোষের মত বাচাল বিরোধী ও আক্ষরিক অর্থে অনধিকারীও অর্থনীতির নোবেল লরিয়েটদের আক্রমণ করেছেন অসীম স্পর্ধিত অভব্যতায়।
২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘট সফল করতে পথে নেমেছে আসানসোল – দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক সংগঠনগুলি >>
অভব্যতা অবশ্য দিলীপ ঘোষের দলেরই করায়ত্ত নয়। বেশি নয়, সামান্য পিছন ফিরলেই মনে পড়ে যাবে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে বিরোধী আন্দোলনকারীদের কী ধরনের ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন তৎকালীন সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল নেতারা।
প্রয়াত সিপিএম নেতা অনিল বসুর বিরুদ্ধে তো তাঁর দলকে মুখরক্ষার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হয়েছিল। তবে অনিল বসু জেলার নেতা ছিলেন, অপেক্ষাকৃত সহজ টার্গেট।
মেধা পাটেকরকে পশ্চাৎদেশ প্রদর্শনের আহ্বানকারী শীর্ষ নেতা বিমান বসু বহাল তবিয়তেই ছিলেন, আছেন। এ কোনও কাকতালীয় ব্যাপারও নয় যে সে সময়ে এ রাজ্যের ক্ষমতাসীন সিপিএম পরিচালিত বাম সরকারের স্বজন-বান্ধব হয়ে উঠেছিলেন, টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা।
বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এসব নিয়ে যে নতুন করে চর্চা হতে শুরু করেছে, তার কারণ অবশ্য এই নয় যে রাজনীতিবিদরা কুকথা বলেন।
বিজেপি সরকারের আমলে বাকস্বাধীনতা বারংবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে, বিভিন্ন সময়ে আইনকে কাজে লাগিয়েছেন বিজেপি নেতারা। লুই সোফিয়ার ঘটনা একেবারে বিস্মৃত হওয়ার মত সময় পার হয়নি।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডায় উচ্চশিক্ষারত তামিল ছাত্রী লুই সোফিয়া বিমান তুতিকোরিন বিমানবন্দরে বিমানে বসেই “ফ্যাসিস্ট বিজেপি নিপাত যাক” শ্লোগান তুলেছিলেন।
একাই। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর বয়স্ক বাবা-মা। ওই বিমানে সফর করছিলেন তামিলনাড়ু বিজেপি সভানেত্রী তামিলসাই সৌন্দর্যরাজন।
তাঁর নির্দেশে পুলিশ লুই সোফিয়াকে গ্রেফতার করে। তামিলসাই সাংবাদিকদের বলেন, “যে ফ্যাসিস্ট শব্দটা উচ্চারণ করতে পারে, সে আর যাই হোক নিরীহ নয়”।
তামিলসাইয়ের বক্তব্যটি অনুধাবনযোগ্য। সরকারকে যে নাগরিক ফ্যাসিস্ট বলে, তাকে আর যাই হোক নিরীহ বলা চলে না, এটা একেবারেই সরকারি সত্য।
সরকারি সত্য আরও একটু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যে নাগরিক বা যে ব্যক্তি সরকারের সমালোচনা করবে, তাকেই সন্দেহ করতে হবে, এবং প্রয়োজনানুসারে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে। অশীতিপর কবি কিংবা পাদ্রি (ভারভারা রাও, স্ট্যান স্বামী), অধ্যাপক (সোমা সেন, ভার্নন গনজালভেজ) কিংবা সাংবাদিক (গৌতম নওলাখা), অথবা আইনজীবী (সুধা ভরদ্বাজ), এবং আরও অনেককে জেলে ভরে রাখতে হবে।
এই তালিকার সকলেই বিজেপি জমানায় গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মাওবাদী যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বাংলার শাসকরা খুব পিছিয়ে থাকেননি।
রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বা যাদবপুরের সেন্ট্রাল গ্লাস অ্যান্ড সেরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন অধ্যাপিকা নিশা বিশ্বাস মাওবাদী যোগের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন বাম সরকারের আমলেই। তাঁরা দুজনেই অবশ্য খালাস পেয়েছেন।
বিশেষ অজ্ঞের কোভিদ জিজ্ঞাসা 2 >>
সরকারের সমালোচকরা এখন প্রায়শই দেশদ্রোহী নামে অভিযুক্ত হন। এর সৌজন্য আইটি সেলের। কেন্দ্রের সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও এখন আইটি সেলের ভাষাতেই কথা বলে।
নেতারা বলেন অমুক আর্বান নকশাল, বলেন তমুক দেশদ্রোহী। সরকারের উচ্চপদাসীনরা এরকম কথা বললে একটু নড়েচড়ে বসতে হয় সকলকেই।
তেমনই নড়েচড়ে বসেছিল আইন কমিশন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বি এস চৌহানের নেতৃত্বে আইন কমিশনের এক প্যানেল মতপ্রকাশ ও বক্তব্যের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে গত বছর বলেছিল, ‘‘গণতন্ত্রে সবাই এক কথা বলাটা দেশপ্রেমের নিদর্শন হতে পারে না। দেশের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করার জন্য সকলেরই নিজস্ব পথ অবলম্বনের স্বাধীনতা রয়েছে।
এবং সেই লক্ষ্যেই কেউ গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারেন, সরকারি নীতির ফাঁকফোকর গুলোকে চিহ্নিত করতে পারেন।
তা করতে গিয়ে তাঁদের বক্তব্য কঠোর হতে পারে, যা কারো কারো কাছে অস্বস্তি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সে কারণে তাঁদের দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া ঠিক নয়।”
গণতন্ত্রে সবাই এক কথা যে বলতে পারে না, সে কথা বিশ্বাস করে সাংবাদিক বিনোদ দুয়া ‘প্রধান সেবক’ সম্পর্কে নিজ মত ব্যক্ত করেছিলেন।
তাঁকে গ্রেফতারি এড়াতে শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান গ্রেফতার হয়েছেন যোগীরাজ্যে।
হাথরসে দলিত মহিলাকে ধর্ষণের পর সেখানে যাবার সময়ে। এঁদের ক্ষেত্রে বিজেপি নেতাদের দলগত ও ব্যক্তিগত স্তরে যা ভূমিকা, তেমনটা প্রত্যাশিতই। মুশকিল হয়ে গেল অর্ণব গোস্বামী গ্রেফতার হওয়াতে। সাংবাদিকের অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকারের মত দক্ষিণপন্থীদের সিলেবাসের বাইরে থাকা বিষয়গুলি তাঁদের ঠোঁটে এনে ফেলতে হল। অবশ্য ফলও মিলেছে।
নির্লজ্জভাবে যিনি সরকারের স্তাবকতা করে থাকেন, তিনি স্বস্থানে ফিরেছেন।
এদিকে কেরালায় পাশ হয়ে গিয়েছে নতুন এক বিল। রাজ্যপালের অনুমোদন পেয়ে যাবার পর কেরালার বাম সরকার এবার সোশাল মিডিয়ায় আপত্তিকর পোস্টের জন্য যে কোনও নাগরিককে পাঁচ বছরের জন্য জেলে পাঠাতে পারবে। কেরালা রাজ্য মন্ত্রিসভা স্পষ্টই বলেছে পুলিশের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা দিতে এই আইন আনা হয়েছে।
অম্বিকেশ মহাপাত্রের কথা স্মরণে না থাকার কিছু নেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার সোশাল মিডিয়া পোস্টের জন্য এই অধ্যাপককে গ্রেফতার করেছিল।
আরামবাগ টিভি-র সফিকুল ইসলামের গ্রেফতারি এই সেদিনের ঘটনা।
গণতন্ত্রের স্বার্থে যাঁরা নিজেদের ক্ষমতায় আসা জরুরি বলে দাবি করেন, তাঁরাই যে গণতন্ত্রকে সবচেয়ে বেশি ভয় পান, সে কথা বারংবার সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। অনাগত ভবিষ্যতে আমরা সম্ভবত আলিঙ্গন করতে চলেছি বহুচর্চিত, বহুনিন্দিত ও নন্দিত অরওয়েলের উপন্যাস ১৯৮৪-কে। এক শিশুর মুখে লাথি মারতে উদ্যত বুটপরা এক পা, এ-ই বোধহয় নাগরিকের ভবিতব্য।
