বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
বিখ্যাত মানুষের মৃত্যুতে সব শেষ হয়ে যায় না। তার রেশ চলতেই থাকে মৃত মানুষটিকে নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে চর্চা ও চলতে থাকে।
প্রণব মখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বর্তমানে বড়ো বড়ো বাঙালির অধিকাংশই বিলেতেই থাকেন।দেশে যে কয়জন রয়েছেন তাদের সংখ্যা কমে আসছে।
চলতি দশকের শুরুতে মৃত্যু হয়েছিল জ্যোতি বসুর। দুহাজার কুড়িতে এসে আমরা হারালাম প্রণব মুখোপাধ্যায় কে।
প্রাপ্তির বিচারে এই দশক বাঙালিকে রিক্ত করেছে।
জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পরে তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আলোচনা আজও চলমান। সেই আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কুর্শি। নয়ের দশক থেকে যে মিলিজুলি সরকারের পর্ব দেশে শুরু হয়েছিল তার মধ্যভাগে জ্যোতি বসুর কাছে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু সিপিএম সেই প্রস্তাবে সায় দেয় নি।
দলের এই সিদ্ধান্তকে জ্যোতি বসু বলেছিলেন ঐতিহাসিক ভুল। সর্ব ভারতীয় স্তরে নীতি নির্ধারক এর পদে যাওয়ার পথে এই বাধা বঙ্গবাসী কে হতাশ করেছিল।
প্রণববাবুর মৃত্যুতে এই ধরনের প্রসঙ্গ আলোচনার মধ্যে নেই কারণ প্রণব মুখোপাধ্যায় এর কাছে এমন কোনো প্রস্তাব আসেনি। যদিও দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে প্রণব বাবুর সামনেও সুযোগ এসেছিল।
আর সেদিন যদি প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে আজ দেশের বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকারের সামনে যে পাঁচিল দেখা যাচ্ছে তা দেখা যেত না।
১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর নিহত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সেই সময় অনেকেই ভেবেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন প্রণব বাবু।
১৯৬৪ সালে জহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন গুলজারিলাল নন্দা, কারণ সেই সময়ে তিনিই ছিলেন মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্য। অল্প দিন পরেই প্রধানমন্ত্রী হন লালবাহাদুর শাস্ত্রী।
বছর দুয়েকের মধ্যে শাস্ত্রীজির মৃত্যু হলে ফের মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্য হিসেবে গুলজারিলাল নন্দা প্রধামন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
এই পরম্পরা মেনে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে প্রণব বাবুরই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিল। ওই সময় তিনিই ছিলেন মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্য।
অনেকেই মনে করেন সেদিন যদি প্রণব বাবু প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে রাজিব গান্ধী যে ভুল গুলি করেছিলেন তা প্রণব বাবু করতেন না।
জীবনের প্রথম তিরিশ বছর প্রণব বাবু প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে ছিলেন না।

তারপরে তিনি রাজনীতিতে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বাংলা কংগ্রেস নেতা অজয় মুখোপাধ্যায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি।
১৯৬৯ সালে যুক্তফ্রন্টের সহায়তায় বাংলা কংগ্রেসের হয়ে তিনি রাজ্যসভার সাংসদ হন। সেদিন থেকে যে রাজনৈতিক দর্শন ও প্রজ্ঞার নিদর্শন তিনি রেখেছেন তাতে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় রাজীবের ভুল তিনি করতেন না।
১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৫১৪ টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৪০৪টি আসন পেয়েছিল। দেরিতে ভোট হওয়া কয়েকটি আসনের মধ্যে আরো দশ টি আসন জিতেছিল কংগ্রেস।
রাজীবের রাজনৈতিক কৌশল বা জনপ্রিয়তায় এই বিপুল জয় আসেনি। এসেছিল এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরার মৃত্যুতে সহানুভূতির ঝড়ে। একেবারেই ভিন্ন জগৎ থেকে রাজনীতির ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ কেন্দ্রে এসে পড়েছিলেন রাজীব।
ভারতের মত বহুমাত্রিক দেশে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘাত প্রতিঘাত এবং জনগোষ্ঠীর জটিল বিন্যাস বোঝার ক্ষমতা রাজীব গান্ধীর ছিল না।
ফলে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ কে ক্ষমতার বৃত্তে এনেছিলেন রাজীব। সেই কোটারির পরামর্শ নিয়েই ছোটেন রাজীব। পাঁচ, ছয় ও সাতের দশকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ছাড়া আর কেউ রাম মন্দির নিয়ে মাথা ঘামাত না।
১৯৮৬ সালে হটাতই রাম মন্দির নিয়ে বিরাট শোরগোল পড়ে যায়।
১৯৮৫ সালে শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়। সুপ্রিম কোর্ট বলে তালাক দিলেই খোরপোষ দিতে হবে। এই রায় মুসলিম মৌলবাদীদের স্বার্থে আঘাত করে। তাই এই রায়ের পরে মোল্লারা দেশ জুড়ে হই চই শুরু করেছিল।
রাজীবের পারিষদ রা তাকে বোঝান মোল্লাদের খুশি করতে না পারলে মুসলিম ভোট হাতছাড়া হবে। তাই শীর্ষ আদালতের রায় কে ভোঁতা করতে রাজীব সরকার নতুন আইন আনেন।
এরপর রাজিব ঘনিষ্ঠ রা বলেন হিন্দুদের ও খুশি করতে হবে, না হলে বিপদ।সেই সময় রাজীবের বন্ধু এবং কেন্দ্রীয় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দপ্তরে মন্ত্রী অরুণ নেহরুর পরামর্শে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের তালা খোলার সিদ্ধান্ত হয়।
ফৈজাবাদ আদালতকে বুড়ি ছোঁয়া করে ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাম মন্দিরের তালা খুলে দেওয়া হয়। তালা খুলতেই হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক বিষিয়ে যায়।
১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাগপুরে বৈঠকে বসেন আরএসএস প্রধান বালা সাহেব দেওরস।
সেই বৈঠকে তিনি বলেন চলতি বছরের শেষে লোকসভার ভোট হবে। ৮৪ র ভোটে ইন্দিরা মৃত্যুতে সহানুভূতি এবং শিখ দের বিরুদ্ধে খেপিয়ে হিন্দু back lash এ কংগ্রেস জিতেছিল।
এবার হিন্দু ভোট পেতে আমাদের ইস্যু হবে রাম মন্দির।
সেদিনের সেই শুরুর পরিণতি হলো ৫ আগস্ট অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভূমি পুজন।
রাজীব জমানা ছাড়া ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকে ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত কংগ্রেসের সংকটে, দেশের সংকটে think tank এর মধ্যমণি ছিলেন প্রণব বাবু।
রাজনৈতিক অনুমান শক্তি ও প্রজ্ঞার জোরেই সরকার ও দলের অন্যতম মস্তিষ্ক হয়েছিলেন তিনি। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় ১৯৮৪ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হলে রাজীব গান্ধীর ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের খেসারত ভারতবাসীকে দিতে হত না।
