
পারিজাত সেনগুপ্ত
ক্লাসরুম কেন্দ্রিক শিক্ষার গতানুগতিকতা থেকে শিক্ষার্থীকে বের করে আনতে,মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটাতে,আন্তর্জাতিকতাবাদ ও মহামিলনের মন্ত্রকে জাগরুক করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরম মমতায় গড়েছিলেন বিশ্বভারতী। কিন্তু আজ সেই প্রতিষ্ঠান শিক্ষার উৎকর্ষ জনিত কারণে নয় বরং বিশৃঙ্খলা, প্রাতিষ্ঠানিক সন্ত্রাসের কারণে সংবাদের শিরোনামে।
আজ আক্ষরিক অর্থে উপাচার্যের সৌজন্যে বিশ্বভারতী এক কারাগার যেখানে মুক্ত চিন্তা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রবেশ নৈব নৈব চ। সাম্প্রতিক বিতর্কের কারণ অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্যের সাসপেনশন এবং তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিবাদের দুই অগ্রনী মুখ অর্থনীতি বিভাগের দুই ছাত্র ফাল্গুনী পান ও সোমনাথ সৌ কে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে রাতারাতি ই মেলে সাসপেন্ড করা।প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের শান্তিনিকেতন সফরের সময় এই দুই বামপন্থী ছাত্রকে সারাদিন পুলিশের দ্বারা গৃহবন্দী করে রাখার অভিযোগ ওঠে।
এটা কোন কাকতালীয় বিষয় নয় যে ২০১৪ সালে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সরকারের আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়।
যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরাই হিন্দুত্ববাদী ভাবনা ও শিক্ষার গৈরিকীকরণের বিরোধিতা করে তাই জেএন ইউ,দিল্লি,জামিয়া মিলিয়া,হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলি সংঘ পরিবার ও তার শাখা সংগঠনগুলির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়।
সেই ধারাবাহিকতায় কি এখন আক্রমনের লক্ষ্য বিশ্বভারতী? আমরা কথা বলেছিলাম সাসপেন্ড হওয়া দুই ছাত্র, অধ্যাপক ও বোলপুর স্থিত এক প্রবীণ মানবাধিকার কর্মীর সঙ্গে।
ফাল্গুনী পান বিশ্বভারতীর বর্তমান অবস্থাকে এক পরিকল্পনার অংশ বলেই মনে করেন।তার মতে ২০১৮ সালে উপাচার্য পদে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী নিযুক্ত হওয়ার পরে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী,শিক্ষক ও কর্মীদের উপর আক্রমণ শুরু হয়েছে। ফান্ড না থাকার অজুহাতে ফি বৃদ্ধি, হস্টেলের উন্নতি সাধন না করা,আন্দোলন না করার জন্য কর্মীদের কাছে মুচলেকা নেওয়া,যত্রতত্র সিসিটিভি লাগানো সেই পরিকল্পনার অংশ।
শান্তিনিকেতনের সুমহান ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, আলাপনী সমিতির ঘর কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আশ্রম সংঘের অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অন্যদিকে হলকর্ষণ উৎসবে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের প্রাক্তন সভাপতিকে প্রধান অতিথি করা হয়েছে। বিগত বছরে সারা দেশ যখন এনআরসি,সিএএ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল তখন এখানেও ছাত্র ছাত্রীরা সরব হয়।
সেসময় উপাচার্য বিজেপি নেতা স্বপন দাশগুপ্তকে ডেকে আনা হয় এনআরসির পক্ষে বলতে কিন্তু বিরুদ্ধ মতের কাউকে ডাকা হয় নি।
সেসময় বহু সংখ্যক শিক্ষার্থী পথে নামেন।বর্তমানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যই অধ্যাপক ও ছাত্রনেতাদের সাসপেনশন।তবে ফাল্গুনীর মতে অতিমারী পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিকে বন্ধ রাখা হয়েছে। তাই সমস্ত শিক্ষার্থী প্রতিবাদে সরব হতে পারছে না।
তাই তারা ঐক্য মঞ্চের পক্ষ থেকে একদিকে দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জানাচ্ছেন অন্যদিকে ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আরেক প্রতিবাদী ছাত্র সোমনাথ সৌ এর মতে এই উপাচার্যের আমলে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের যে সুসম্পর্ক ছিল তা নষ্ট হতে বসেছে।আজ বোলপুরের সমস্ত রাজনৈতিক দল মায় বিজেপির স্থানীয় নেতৃত্ব প্রশাসনের উপর ক্ষুব্ধ।
যেভাবে উপাচার্য কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে উচ্ছেদ করতে ও প্রাচীর দিতে চেয়েছিলেন তার তীব্র প্রতিক্রিয়া জনমানসে পড়েছে। তার মতে এবার যে অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্যকে সাসপেন্ডও করা হয়েছে তার প্রথম কারণ উপাচার্য যেভাবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে অপমান করেছেন তার যুক্তিসহ প্রতিবাদ করেন সুদীপ্তবাবু।
একই সঙ্গে উপাচার্যের স্নেহধন্যা পাঠভবনের অধক্ষ্যা যে নিয়োগ প্রক্রিয়া করেছেন তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা।
যে কোন প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে মরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আজ একের পর এক সাসপেন্ড করছেন।এই উপাচার্যের আমলে এখনো পর্যন্ত ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী মিলিয়ে ২৩ জন কে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধ্যাপক বললেন আজ শান্তিনিকেতনে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিনের মানবাধিকার কর্মী শৈলেন মিশ্র কিছু দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রাচীর দেওয়ার বিরুদ্ধে যে গণ বিক্ষোভ দেখা যায় তার সামনের সারিতে ছিলেন।উপাচার্য তার নামেও এফ আই আর করেছেন।
শৈলেন বাবুর মতে তিনি কোনদিন এই বিশ্বভারতীতে এরকম কয়েদখানার পরিবেশ দেখেন নি।তার মতে সারা দেশে আজ এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কি কেন্দ্রীয় কি রাজ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই বসছে।এখানেও হিন্দুত্ববাদী সরকারের পেটোয়া লোক বসানোর ফলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। তবে তিনি আশাবাদী শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও স্থানীয় মানুষদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ অবস্থার বদল ঘটাবে।
