
তাপস দাশ
শনিবার ছিল কথা রাখার কথা। তা, সে কথা রেখেছেন দুজনেই। শুধু তাঁদের কথা মেলেনি। তেলেজলে হয়ে গিয়েছে।
বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় ও তৃণমূল সরকারের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই জানিয়েছিলেন, শনিবার তাঁরা তাঁদের নতুন বক্তব্য জানাবেন। দুজনের এ সম্পর্কিত ঘোষণাতেই ছিল এসপার-ওসপারের সুর।
ফেসবুক লাইভে এদিন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, যে তিনি যুবশক্তির অপচয়ে অতীব বিব্রত। রাজীব চান, যুবসমাজকে কেউ পথ দেখাক।
রাজীব দীর্ঘদিন ধরে পথ খুঁজছেন, বেরোনোর পথ, এমন কথা আকাশ-বাতাসে ঘুরছে। কিন্তু রাজীব যাচ্ছেন না। যাব কি যাব না করছেন। এদিনের ফেসবুক লাইভে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শের অনুগমন করতে চান, কিন্তু তাতে বাধা পাচ্ছেন। তাঁর কাজে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, এবং তা নজর এডিয়ে যাচ্ছে, এমন অনুযোগও করেছেন তিনি।
রাজীবের এদিনের বক্তব্যের বেশিরভাগ অংশ জুড়েই ছিল যুবসমাজের প্রতি বঞ্চনা নিয়ে ক্ষোভ। নির্দিষ্ট কারও প্রতি ক্ষোভের আঙুল না তুলে তিনি বলেছেন, ‘আমি ভোটের আগে মুখ খুলেছি এমন নয়। সিস্টেমে কোথাও কোনও সমস্যা রয়েছে বলে মনে হলে দলীয় ভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় সমস্যার কথা জানিয়েছি। যখন যেখানে যে ফোরামে জানানোর দরকার জানিয়েছি। এমন নয় যে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় আজকে বলছে’।
তিনি জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন তাঁর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বুঝে নিতে।
শতাব্দী রায় অবশ্য মানুষকে তত কষ্ট দেননি। কারণ আগের দিন তাঁর ঘোষণার পরে পরেই যুব তৃণমূলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়েছে। সে বৈঠকে তিনি কতটা তুষ্ট, তা বোঝাতে শতাব্দীর ফেসবুক পোস্টের একটি উদ্ধৃতিই যথেষ্ট। “যেভাবে তিনি সমস্যা শুনেছেন, আলোচনা করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, তাতে আমি নিশ্চিত তরুণ নেতাটি এখন যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও পরিণত। নতুন প্রজন্মের এমন নেতার নেতৃত্ব দলকে শক্তিশালী করবে।” বাংলার স্বার্থে তৃণমূল পরিবারকে যে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে সে কথা এদিন মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনবারের এই সাংসদ।
রাজীব ও শতাব্দী দুজনের কথায় দুটি ভিন্ন মতধারা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দুজনের মধ্যে মিল রয়েছে। মিল হল, এঁরা উভয়েই যুবনেতা অভিষেককে নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। ক্ষোভ মেটায় শতাব্দী অভিষেক নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, রাখঢাক না করেই। ক্ষোভ না মেটায় রাজীব অভিষেককে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, রাখঢাক করেই।
তৃণমূল কংগ্রেস থেকে যাঁরাই বেরোচ্ছেন, পা বাড়িয়ে রয়েছেন, খেয়াল করলে দেখা যাবে, তাঁদের কেউই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন না, করছেন অভিষেককে নিয়ে, বা মমতার প্রতি ক্ষোভ, অভিষেককে প্রশ্রয় দেওয়া নিয়ে।
রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসবিহীন অভিষেক, মূলত আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসা একটি দলের ক্ষমতাশীর্ষে চলে যাচ্ছেন, এটা এঁদের পক্ষে নেওয়া অসুবিধাজনক মনে হচ্ছে।
শুভেন্দু অধিকারীদের মত আন্দোলনের লোকের কাছে অভিষেককে ভুঁইফোঁড় মনে হওয়া খুন অস্বাভাবিক নয়।
বিদেশে বাস করে আসা, এসেই সরকার ও দলের ক্ষমতার অলিন্দে মধ্যমণি হয়ে ঘুরে বেড়ানোর জেরে অভিষেকের যে কিছু স্তাবকবৃন্দও তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু সন্দেহের অবকাশ যা নিয়ে, তা হল, আজ না হোক কাল, তৃণমূলকে যদি আন্দোলনের পথে নামতে হয়, তা হলে মমতাবিহীন সে দল দিকভ্রষ্ট হয়ে পথে ঘুরে বেড়াবে, এ কথা জানার জন্য জ্যোতিষবিদ বা রাজনীতিজ্ঞ হবার দরকার পড়ে না। খালি চোখেই তা দিব্য দেখা যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে দিব্যদৃষ্টি আছে, সে কথা তাঁর ভজনাকারীও বলবেন না সম্ভবত। কিন্তু তাঁর যে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার প্রবণতাটি রয়েছে, তা যে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি অভিষেককে দিয়ে যাচ্ছেন না, সে কথা সম্ভবত তিনি নিজেও জানেন।
ফলে রাজীবের ক্ষোভ থাকছে, শতাব্দীর ক্ষোভ মিটছে। টানা আর পোড়েন দিয়ে চলছে তৃণমূলের তথাকথিত পরিবার। আর বাংলার তৃণমূল পরিবারকে একজোট হবার ডাক দিয়ে আগামী সপ্তাহে সপরিবারে গোয়া যাচ্ছেন শতাব্দী রায়।
