
তাপস দাশ
বৃহস্পতিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, কংগ্রেসের তরফ থেকে জানান হয়েছে, দলের হাইকম্যান্ড পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সঙ্গে জোটে সম্মতি দিয়েছে। তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, এ জোট আগে থাকতেই হয়েছিল, তাতে কেবল শিলমোহরটুকু পড়েছে। জোট এবার অফিশিয়াল।
সিপিএম গত অক্টোবর মাসেই জানিয়ে দিয়েছিল, তারা ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করবে।
কৌতুকপ্রদ বিষয় হল, সিপিএমের মত ডাঁটোয়াল দল, দু মাস আগে থেকে জোটের জন্য উচ্চমহল থেকে হাত বাড়িয়ে রেখেছিল, কংগ্রেসি করমর্দনের প্রতীক্ষায়, এবং কোনওরকম বেগড়বাঁই না করে অপেক্ষা করতে থেকেছিল।
ক্রিসমাস ইভে সাত বুড়োর এক বুড়ো কংগ্রেস দল, সান্তা ক্লজ হয়ে সিপিএমের ঝুলিয়ে রাখা মোজায় তাদের ইচ্ছেপূরণের অফিশিয়াল বার্তাটি দিয়েছে।
এর আগের বিধানসভা ভোটের সময়েও সিপিএম ও কংগ্রেসের জোট হয়েছিল। সূর্যকান্ত মিশ্রের গললগ্ন মানস ভুঁইয়ার ছবি সম্প্রচারিত হয়েছিল বহুল পরিমাণে। কিন্তু সে জোট কাজে দেয়নি। তৃণমূল ফিরেছিল বিপুলভাবে। আর সিপিএম হেরেছিল প্রবলভাবে। ২০১১ সালে প্রথমবার পরাজয়ের পর, সিপিএম নেতৃত্ব ঠিক কী ভেবেছিলেন তা বলা মুশকিল, তবে সিপিএমের এঁড়ে সোশাল মিডিয়াংশের কথাবার্তা দেখলে মনে হয়, ‘মানুষ ভুল করেছে’ সিনড্রোম তাঁদের ছেড়ে যায়নি। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের তিন বছর পর, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভোট শেয়ার ৭ শতাংশে নেমে এসেছিল।
এটা ঘটনা যে লোকসভা ভোট ও বিধানসভা ভোটের হিসেব আলাদা হয়। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে বিশ্লেষকরা ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের বিধানসভা ওয়ারি ফলাফল গণনা করে দেখিয়েছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থা ভাল নয়। সেবারের বিধানসভা ভোটের ফল তাঁদের ভুল প্রমাণ করেছিল।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে তা সত্ত্বেও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট নিয়ে পারিসাংখ্যিক ছেঁড়াকাটা চলছে। কংগ্রেস ও সিপিএমের ভোটপ্রাপ্তির হিসেবও হচ্ছে। তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সিপিএমের ভাঁড়ারের ফুটিফাটা হাল। অন্যদিকে অধীর চৌধুরী জলোয়া দেখিয়ে কংগ্রেসের পায়ের তলায় নতুন মাটি দিয়েছিলেন। তার পুরস্কার হিসেবে তিনি সংসদে এখন কংগ্রেসের দলনেতা।
অন্যদিকে ২০১৯ লোকসভা ভোটে সিপিএমের দলীয় ভোট যে বিজেপি-তে গিয়েছিল, সে তথ্য সর্বজনবিদিত। সিপিএম এ কথা স্বীকার করেছে, আবার অস্বীকারও করেছে। এক নেতা বলেইছিলেন, তাঁদের ভোটাররা যে পদ্মচিহ্নে বোতাম টিপেছিলেন, সে কথা তাঁরা জানেন। আবার আরেক দল নেতারা যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেছিলেন, যে ভোটাররা দলীয় সম্পত্তি নয়।
২০২১ সালের ভোটে সিপিএমের কাছে তৃণণূল ও বিজেপি উভয়েই মূল শত্রু, তাদের যুক্তি বিন্যাসে, মোদী ও মমতার মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে।
এসব ব্যাপারে কংগ্রেস বামেদের চেয়ে ঐতিহাসিকভাবেই দূরদর্শী, এবং ঐতিহাসিক ভাবেই বামেরা কংগ্রেসের পিছনে জোট প্রসঙ্গে ছুরি মেরে এসেছে। কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে সারা দেশে বেশ কিছু জনমুখী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তর্কযোগ্যভাবে ইউপিএ সরকারই স্বাধীন ভারতে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা জনমুখী ভূমিকা নিয়েছিল।
কংগ্রেসকে সে সময়ে কোয়ালিশন সরকার চালানো ও টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এমন কিছু পদক্ষেপ করতে হয়েছিল যা কেবলমাত্র কংগ্রেসচালিত সরকার কখনওই করেনি। দ্বিতীয় ইউপিএ কোয়ালিশন ভেঙে গিয়েছিল, মুখ্যত সিপিএমের জন্য। পরমাণু চুক্তি নিয়ে তাদের অবস্থান ছিল অনড়। এর পর কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, এবং তারপর আবার। এই ইতিহাস সত্ত্বেও ২০১৬ সালে কংগ্রেস সেই বামেদের সঙ্গেই ফের জোট করেছে, এবং ২০২১ সালেও সেই একই রাস্তা নিয়েছে।
দীর্ঘদিনের পুরনো দল হওয়ার কারণে, এবং বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে বোঝাপড়া করে ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা কংগ্রেসকে বাস্তবমুখী করেছে।
অজস্র উপদল, গোষ্ঠী রাজনীতি, এবং বারবার দল ভাঙার অভিজ্ঞতাপুষ্ট কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত যে সামলে উঠতে পারে, মুছে যায় না, তার কারণ তাদের এই বাস্তবানুগতা।
অন্যদিকে সিপিএম ও তাদের নেতৃত্বাধীন বাম দলগুলি কেরালা, বাংলা ও ত্রিপুরার মত ছোট রাজ্য ছাড়া কখনওই সেভাবে তেমন ছাপ ফেলেনি। কোথাও কোথাও তাদের নেতৃত্বে মিছিল বা স্বল্পমেয়াদী ও মধ্যমেয়াদী আন্দোলন হয়েছে বটে, কিন্তু তাকে ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত করার সামর্থ্য তাদের প্রায় বিলকুল নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মাঝে পড়লে স্বাভাবিক সংসদীয় ভব্যতা বিষয়টিও তারা যে বিস্মৃত হয়, তার বহুল প্রমাণ রয়েছে।
এ রাজ্যে বিমান বসুরা তার বহুবিধ প্রমাণ রেখেছেন, যার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। বরং মনে করা যেতে পারে গত লোকসভা নির্বাচনে রাহুল গান্ধী কেরালার ওয়েনাড় লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেবার পর, সেখানকার বর্ষীয়ান সিপিএম নেতার প্রতিক্রিয়া। এটা ঘটনা যে রাহুল সেখান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিপিআই প্রার্থীর নাম ঘোষিত হবার পর।
কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ওই কেন্দ্রে প্রচারের সময়ে তিনি সিপিএমের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন না। অন্যদিকে কেরালা সিপিএমের মুখপত্র দেশাভিমানী-তে কেরালা সিপিএমের অবিসংবাদী নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাহুল গান্ধীকে ‘আমুল বেবি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, দেশাভিমানীর সম্পাদক এক টিভি চ্যানেলে ভুল স্বীকারও করেছিলেন। ঐতিহাসিক ভুল, ও তা পরবর্তী কালে স্বীকার করার একটা ধারাবাহিকতা সিপিএমের রয়েছে। এবং না স্বীকার করার ধারাবাহিকতাও রয়েছে। দ্বিতীয় তালিকাটি যে দীর্ঘতর হবে, সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের জোট কি ঠিক না ভুল, তারও হিসেব সম্ভবত কিছুকাল পরে হবে। ২০২১-এর ভোট মিটলে। ভোটে জোটের ফল ভাল হলে একরকম হিসেব, খারাপ হলে আরেকরকম।
মুশকিল হল, এ জোটের ভোট পাবার জন্য কেবলমাত্র মানুষের রাজনৈতিক চেতনার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, কারণ কংগ্রেস ও সিপিএম জোটকে গত পাঁচ বছরে কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে দেখা যায়নি, যার জেরে ভোট দেবার সময়ে এ জোটের কথা মানুষের মনে পড়তে পারে।
বরং প্রতি ভোটের আগে জোট গড়া ও জোটের সভা করা, দুই দলকে স্বার্থসন্ধানী বলে পরিচিত করিয়ে তুলবে, এমন আশঙ্কা রয়েছে। সাড়ে তিন দশক ক্ষমতায় থাকার পর গত এক দশকে কোনও আন্দোলন, কোনও কর্মসূচিবিহীন একটি ফ্রন্টের সঙ্গে কংগ্রেস যে জোট করছে, এ তাদের বৃহৎ ছবি দেখতে পারার ক্ষমতা ও দূরদর্শিতা থেকেই।
এরকম পরিস্থিতিতে সিপিএম যে এমন কোনও দলের সঙ্গে জোট করত না, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সে দূরদর্শিতা তাদের নেই, থাকলে এ হাল হত না।
