বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
ভোটের দিন বুক দিয়ে বুথ আগলালো সিপিএম আর ভোট নিয়ে গেলো বিজেপি।২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিভিন্ন জেলার ফল বিশ্লেষণ করে এই তথ্যই জমা পড়েছে আলিমূর্দিন স্ট্রীটে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই উলোট পুরান ই রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগে ভাবাচ্ছে তৃণমূলকে। আসন্ন বিধানসভা ভোটেও এই ছবিটা যদি বজায় থাকে তাহলে এবারও অনেক হিসেব উল্টে যাবে। বাম ভোটের এই মতিগতিতে অস্বস্তি রয়েছে সিপিএমের অন্দরেও। আগামী বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস সিপিএম জোটের শলতে পাকান শুরু হয়েছে। পাশাপাশি আমফানের ত্রানে দুর্নীতি এবং অতিমারিতে মানুষের দুর্ভোগ এই দুই কে হাতিয়ার করে পথে নেমেছে সিপিএম। সিপিএমের দাবী এই কর্মসূচিতে মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে কর্মী সমর্থকদের ভিড় ও বাড়ছে। সাম্প্রতিক কৃষি বিলের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে রাজ্যে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে লাল ঝান্ডা। এই পরিস্থিতিতে বিধানসভা ভোটে সিপিএমের জমিতে যদি পদ্ম ফোটে তা হলে দল ধরে রাখাই যে কঠিন হবে তা সিপিএম নেতারা ভালই জানেন।
এই ভোটেও বাম সমর্থক রা যদি তৃণমূলকে জব্দ করতে বিজেপি কে ভোট দেন এই আশঙ্কা তৃণমূলের অন্দরেও জোরালো হচ্ছে। ১৯৮৯ সাল থেকে উত্তর বঙ্গ কে ফোকাসে রেখে শাখা ছড়াতে শুরু করে আরএসএস। প্রায় দু দশক পরে চা বাগান সহ আদিবাসী – মূল বাসি ও তফসিলি জাতি এবং উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় সংঘ পরিবার যে শক্ত মাটি পেয়েছে তা কান পাতলেই শোনা যাবে। এর রাজনৈতিক লাভ গত লোকসভা ভোটে পেয়েছে বিজেপি। বামেদের হারান জমিতে ভিত জমাট করেছে সংঘ পরিবার। সংঘের কাজ আড়ালে রাখতে স্কুলকে হাতিয়ার করে নাগপুর। এই দুই দশকে স্কুলের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়াদের মাধ্যমে তাদের পরিবারে ঢুকেছে সংঘের চিন্তন। তাই উত্তরবঙ্গে ভূমি পুত্র রাভা, মেচ ও রাজবংশী দের মধ্যে শাঁখা সিঁদুরের চল বেড়েছে, গ্রামে মফস্বলে বেড়েছে হরিনাম সংকীর্তন ও হরিসভা।
উত্তরবঙ্গের মানবজমিনে এই পরিবর্তনে ছবিটা ছিল ২০১৬ সালের কুচবিহার লোকসভার উপনির্বাচনে। ওই নির্বাচনের ফলে বাম ও কংগ্রেসের জামানত জব্দ হয়। আর ২৮% ভোট বাড়িয়ে তৃণমূলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলে বিজেপি। দেওয়ালের এই লিখন পড়তে পারেনি তৃণমূল। তাই গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল সাত টি আসনেই হেরে যায়। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে প্রায় ৬০ টি আসনের মধ্যে ৫০ টিকেই অনিশ্চিত ধরে নিয়ে এগোচ্ছে তৃণমূল। এই অবস্থায় দক্ষিণবঙ্গে বাম সমর্থকদের মধ্যে আগে রাম পরে বাম এই ঝোঁক তৃণমূলের মাথাব্যথার বড় কারন। দক্ষিণবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, নদীয়া, আসানসোল, পূর্ব বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদে এই ঝোঁক বজায় থাকলে বিজেপির লাভ হবে। এই জেলাগুলিতে বিজেপির সাংগঠনিক ক্ষমতা আর লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। তুলনায় কম হলেও হাওড়া ও উত্তর চব্বিশ পরগনা তেও ভোটের এই প্যাটার্ন দেখা গিয়েছে।
পূর্ব বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রে ফলের দিকে নজর দিলেই বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়। গত লোকসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে ভোটের ১৬ দিন আগে প্রার্থীর নাম ঘোষনা করে ছিল বিজেপি। প্রার্থী এস. অহলু ওয়ালীয়া ভোটের কয়েকদিন আগে নির্বাচনী কেন্দ্রের একটি হোটেলে গিয়ে ওঠেন। ওই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাত টি বিধানসভা তে মাত্র তিন দিন প্রচারে গিয়েছিলেন। ভোটের দিন অধিকাংশ বুথেই বিজেপির এজেন্ট ছিল না। অথচ ফল বেরোতে দেখা গেল বড় ব্যবধানে ভোটে জিতল বিজেপি। একই ছবি আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের । ভোটের দিন দুয়েকটি বিধানসভা কেন্দ্রের কিছু বুথে বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় শোরগোল তুললেও অন্যান্য জায়গার বুথে বিজেপি এজেন্ট সংখ্যা ছিল খুবই কম। ভোটের দিন ওই কেন্দ্রের বুথের পর বুথে ভোট লুট আটকাতে সক্রিয় ছিল সিপিএম, বিশেষ করে রানীগঞ্জ, জামুরিয়া, পান্ডবেশ্বর ও আসানসোল বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন স্পর্শ কাতর বুথে সিপিএম নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী বংশ গোপাল চৌধুরীর নেতৃত্বে সক্রিয় ছিল সিপিএম।
নির্বাচনের ফল বেরোতে দেখা গেল পূর্ব বর্ধমানের মত এই আসনেও জিতেছে বিজেপি। সবথেকে অবাক করা ফল হয়েছে আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রে। বাম জমানায় ভোটের আগে পরে আরামবাগের গোঘাট,খানাকুল ও চমকাইতোলা বারবার রাজনৈতিক সংঘর্ষে অশান্ত হয়েছে। রাজ্যে পালাবদলের পরে এখানে সিপিএমের আধিপত্য গিয়েছে তৃণমূলের হাতে। গত লোকসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে প্রচারের সময় প্রায় কোথাও ই বিজেপির ঝান্ডা দেখা যায় নি। সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রচার ও করতে পারে নি বিজেপি। এমন কি টিভি চ্যানেল কে বাইট দিতে ভয়ে ছিলেন বিজেপি প্রার্থী। অথচ ভোটের ফল বেরোতে দেখা গেলো তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন চার লক্ষ ন হাজার ন শো উন তিরিশ, আর বিজেপি প্রার্থী পেয়েছেন চার লক্ষ্ আট হাজার সাত শ একাশি ভোট।
সিপিএমের মূল্যায়ণ হল ২০১৮ র পঞ্চায়েত ভোটের বঙ্গের এই জেলা গুলিতে বিরোধী দের মাথা তুলতে দেয়েনি তৃণমূল। প্রায় কুড়ি হাজার আসন তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে। ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণায় ভোটার রা তৃণমূলকে জব্দ করতে ভোট দিয়েছে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের গ্রামীণ এলাকার দুশো চব্বিশ টি আসনের বেশ কিছু আসনে যদি এই মনোভাব বজায় থাকে তাহলে রাজ্য রাজনীতির মানচিত্র টা বদলে যাবে। যদিও সিপিএম নেতা রা বলছেন বিধানসভা ভোেট এই ছবিটা দেখা যাবে না তবে বর্তমান সিপিএম নেতা রা মানুষের মনের হদিশ কতটা রাখেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সিপিএমের দাবী সাম্প্রতিক কালে পার্টির কর্ম সূচিতে ভিড় বাড়ছে। তবে সেই ভিড় ইভিএম পর্যন্ত বামেদের সঙ্গে থাকবে নাকি বেপথু হবে তার ওপর আগামী বিধানসভার ভোটের ফল নির্ভর করবে
