
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ছকটা ইদানিং সকলেরই বড্ড চেনা। শাসক দল কোথাও কোনও রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেই সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) বা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি (এনআইএ) অথবা আয়কর বিভাগের মতো সরকার নিয়ন্ত্রিত কিংবা ‘স্বশাসিত’ সংস্থাকে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে।
কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মহারাষ্ট্রে সরকার গড়ার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার পর শরদ পাওয়ারদের বিরুদ্ধে বস্তাপচা পুরনো অভিযোগ খুঁজে পেল কেন্দ্রীয় সরকার।
মণিপুরে যেই বিজেপি সঙ্কটের মধ্যে পড়ল অমনি কংগ্রেসি নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই উঠেপড়ে লাগল। সরকার বেঁচে গেল, তদন্তও ধামা চাপা পড়ল।
রাজস্থানে কংগ্রেস সরকারকে ফেলে দেওয়ার উদ্যোগের মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট যেই কোমর কষে রুখে দাঁড়ালেন, দেখা গেল ঝোলা থেকে কুমির ছানা বের করার মতো বিজেপি খুঁজে পেতে বের করে আনল তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা প্রাচীন অভিযোগ।
এই সেদিন, মহারাষ্ট্রে শিব সেনা বিধায়ক প্রতাপ সরনায়েকের সংস্থায় ইডি হানা দিল। একসঙ্গে বিভিন্ন শহরের অন্তত ১০ জায়গায়। অভিযোগ অর্থ পাচারের। প্রতাপের অপরাধ? তিনি অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ নতুন করে তদন্তের দাবি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন।

বিরোধীরা যাকে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ বলে চিহ্নিত করেই চলেছেন, তা ঘটে চলেছে রাজ্যে রাজ্যে। বিরামহীন ঘটনার স্রোত যেন। প্রতিকার চাওয়া ও পাথরে মাথা ঠোকা প্রায় সমার্থক। সরকার বিকারহীন।
জবাব দেওয়ার কোনও দায়ই যেন নেই! সংসদ বলতে গেলে অচল। করোনার দোহাই দিয়ে গত অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্ব তুলে দেওয়া হল। এখন শীতকালীন অধিবেশনও হবে কি না সন্দেহ। হলেও সরকারের ইচ্ছার বাইরে কিছুই সচল নয়। ছয় বছরে প্রধানমন্ত্রী একবারের জন্যও সংসদে কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি হননি। বাকি সময়েও হবেন কি না সন্দেহ।
সাংবিধানিক বৈধতাকিংবা হেবিয়াস কর্পাস মামলাও সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। এই অবস্থায়এখন চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় কোনও রাজ্যে বিজেপিবিপদে পড়লে সরকার কী করতে পারে। এই যেমন কাশ্মীরের বিরোধী নেতাদের হাড়ে যে নতুন করে দুব্বো গজিয়ে দেওয়া হবে, বেশ বোঝা যাচ্ছে তা।
জম্মু–কাশ্মীর দ্বিখন্ডিকরণ ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর সরকার এখন জেলা উন্নয়ন পর্ষদের (ডিডিসি) ভোট করতে চলেছে। এক মাস ধরে এই ভোট গ্রহণ পর্ব চলবে। সরকারের উদ্দেশ্য দুটো।
প্রথমত, গোটা বিশ্বকে দেখানো যে কাশ্মীর স্বাভাবিক। তারা যা যা করেছে জনতাসমর্থন করেছে।
দ্বিতীয়ত, এই ভোটে স্থানীয় প্রতিষ্ঠিত দলগুলোকে নস্যাৎ করে বিজেপি ও তাদের মদতে তৈরি আপনি পার্টিকে সর্বত্র ক্ষমতাসীন করিয়ে সরকার বোঝাতে চায়, আবদুল্লা ও সঈদ পরিবারের কব্জা থেকে উপত্যকার মানুষ রাজনীতিকে মুক্ত করেছে। মনে রাখতে হবে, ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অঙ্গীকারের কথা শুনিয়েছিলেন।

ভোট ঘোষণার সময় সরকারি গোয়েন্দারা জানিয়েছিল স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো ভোট বয়কটের রাস্তায় হাঁটবে।
সেই ধারণা নস্যাৎ করে ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি), পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), পিপলস কনফারেন্স, আওয়ামি ন্যাশনাল কনফারেন্স, সিপিএম সহ মোট ৭টি দলের জোট ‘পিপলস অ্যালায়েন্স ফর গুপকর ডিক্লারেশন’ বা পিএজিডি ভোটে লড়াইয়ের কথা ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, ডিডিসির সব আসনে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার কথাও জানিয়ে দেয়।
এই সিদ্ধান্ত বিজেপির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আর তা হয়েছে বলেই ফারুক আবদুল্লা সহ কাশ্মীরের বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখলের পুরনো এক অভিযোগ নতুন করে তুলে ধরা হয়েছে।
রাজনীতিতে টাইমিং বড় বিষয়। পিডিপির নেতা ও এই নির্বাচনের প্রার্থী ওয়াহিদ পারাকেও ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হল। তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না মেহবুবা ও তাঁর কন্যাকে। শুক্রবারই মেহবুবা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের দুদিন ধরে বাড়ি থেকে বেরতে দেওয়া হচ্ছে না। কার্যত তাঁরা গৃহবন্দী।
প্রায় একই অভিযোগ পিএজিডির অন্য নেতাদেরও। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তাঁদের প্রচারে যেতে দেওয়া হচ্ছে না অথচ সরকারপন্থী দলের নেতারা দিব্যি রক্ষী নিয়ে প্রচার করছেন। ভোটের লড়াইটা মোটেই সমানে সমানে হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির এই ছক শুধু মাত্র কোনও এক বিশেষ রাজ্যের জন্য নয়। গোটা দেশেই এই এক ছক। বিপুল অর্থবল (ইলেকটোরাল বন্ড মামলার রায় সুপ্রিম কোর্টে এখনও ঝুলে রয়েছে), প্রচুর লোকবল, সরকারি অভিপ্রায় অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, সামাজিক মাধ্যম এবংজো হুজুর মিডিয়ার দাক্ষিণ্যে শক্তিশালী বিজেপি এক এক করে তার রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলো পূরণ করে চলেছে।
বাধাহীন এই পথচলা সম্ভবপর করে তুলেছে বশ্যতা মেনে নেওয়া কিছু প্রাদেশিক রাজনৈতিক দল, যাদের নেতাদের ঘাড়ের উপর ডেমোক্লিসের খাঁড়ার মতো ঝুলে রয়েছে বহুবিধ মামলা, রকমারি তদন্ত এবং সর্বভারতীয় স্তরে দুর্বল বিরোধী ঐক্য।
এর সুযোগ নিয়ে বিজেপির আগামী দিনের সাম্রাজ্য বিস্তারের ব্লু প্রিন্টে প্রথমেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু। তার পর ধাপে ধাপে বেছে নেওয়া হবে অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানা। পরের পর্যায়ে রয়েছে ওড়িশা।
নবীন পট্টনায়ককে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায় বিজেপি এখনও প্রকাশ করেনি। কাজটা কঠিনও। কিন্তু তাই বলে জমি প্রস্তুত করার কাজ তারা বন্ধ রাখেনি। নবীন–পরবর্তী ওড়িশায় প্রধান শক্তি হওয়ার পথে কংগ্রেসকে তারা ইতিমধ্যেই গিলে ফেলেছে।

এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিরোধী শিবিরের ছবিটা কেমন? কংগ্রেস ছন্নছাড়া। সোনিয়া গান্ধী অসুস্থ। রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে দলেই নানাবিধ প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। অপ্রিয় শোনালেও কয়েকটি সত্য অনস্বীকার্য।
যেমন, ১) রাহুল এখনও পর্যন্ত নিজেকে ২৪x৭ রাজনীতিক হিসেবে জাহির করতে পারলেন না। ২) দলের একটা বড় অংশ এখনও নির্বাচিত হওয়ার চেয়ে মনোনীত হতেই পছন্দ করেন।
পরিবারপন্থী হয়েই ছড়ি ঘোরাতে তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাই সাংগঠনিক নির্বাচনের ধার ধারতে চান না। ৩) অন্য বিজেপি–বিরোধী দলকে কাছে টেনে আদর্শভিত্তিক একটা জোট গঠনে যতটা উদ্যোগী হওয়া দরকার, দু:খের কথা এখনও পর্যন্ত তার ছিটেফোঁটা উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়। ৪) কংগ্রেস নেতৃত্বের এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা অন্য বিজেপি–বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলোকেও আড়স্ট করে রেখেছে। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে তাঁরা ঘোর সন্দিহান।
কংগ্রেসের এই অচলাবস্থাজনিত উদ্বেগই অগস্ট মাসে ‘জি–২৩’ নেতাদের চিঠির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। পরিবারপন্থী অনুগত নেতারা ‘গেল গেল’ করে উঠে প্রকৃত প্রয়োজনকে পাশ কাটাতে সচেষ্ট হয়েছেন।
সমস্যাকে আড়াল করে পরিবারতন্ত্র রক্ষার মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতেই বেশি ব্যস্ত। সেই অবসরে সোনিয়া–রাহুল–প্রিয়াঙ্কারা ঘোলা জল থিতু করতে বেশি আগ্রহী। সংগঠনের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক আবহ রচনার কোনও কার্যকর উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান নয়।
বিজেপির বিজয়রথ ঠেকাতে কী করণীয় তার একটা নমুনা বিহার নির্বাচন দেখিয়েছে। সিপিআই(এম এল) নেতা দীপংকর ভট্টাচার্য বারবার বলছেন, বিজেপিই যে এক নম্বর প্রতিপক্ষ প্রত্যেককে তা উপলব্ধি করতে হবে। তিনি যে কথাটা বলছেন তা অনেকটাই পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, সেই রাজ্যে বিজেপির তিন বিরুদ্ধ শক্তি জোটবদ্ধ নয়। কংগ্রেস ও বামপন্থীরা নড়বড়ে একটা জোট করলেও শাসক তৃণমূল কংগ্রেসকে নিয়ে জোট গড়তে পারেনি।
অনাগ্রহ যতটা কংগ্রেস–সিপিএমে, ততটাই তৃণমূল কংগ্রেসে। রাজ্যের ২৭ শতাংশ মুসলমান ভোটে ভাগ বসাতে আসাউদ্দিন ওয়াইসির দলও তৎপর। ফলে বিজেপির আশার আলো ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে।
বিহারের নমুনা কিন্তু যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। প্রশ্ন হল তা কার্যকর করা কতটা সম্ভবপর।

নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির প্রবল উত্থান রুখতে হলে নির্বাচন কেন্দ্রিক জোট কাজের হবে না। কারণ, দেশের মানুষ দুর্বল কেন্দ্র পছন্দ করে না।
তা ছাড়া, কেন্দ্রে জোট সরকারের কার্যকারিতা সেইভাবে সফল না হওয়ায় এই আলগা আলগা জোটের উপর মানুষের আস্থাও কমে গেছে। জি–২৩ নেতারা তাঁদের চিঠির শেষাংশে সমভাবাপন্ন দলগুলোকে এক মঞ্চে আনার প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি কংগ্রেসের গণতন্ত্রীকরণের উপর যে গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তার প্রেক্ষিতে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় আনতে হবে।
এবং সে ক্ষেত্রে সবার আগে উদ্যোগী হতে হবে কংগ্রেসকেই।
কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে সফল আঞ্চলিক দল যাঁরা গড়েছেন, বিজেপির জন্য আজ তারা সবাই অস্তিত্বহীনতায় ভুগছে। জম্মু–কাশ্মীরের পিডিপি, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, ওড়িশার বিজু জনতা দল, অন্ধ্র প্রদেশের ওয়াই এস আর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানার তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি কিংবা মহারাষ্ট্রের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি কেউই নিরাপদ নয়।
এক এক করে বিজেপি এদের প্রত্যেককে হয় বশ্যতা স্বীকার করাবে, নয় অস্তিত্ব লোপ করে দেবে। একা একা কোনও দলের পক্ষেই বিজেপির মোকাবিলা এককথায় অসম্ভব।
এই দলগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টি মোটামুটিভাবে অভিন্ন। কংগ্রেসের উচিত দলছুট এই নেতাদের ঘরে ফেরানো। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আঞ্চলিক দলের নেতাদেরও সেই তাগিদ তীব্রভাবে অনুভব করা উচিত। বিজেপির সার্থক মোকাবিলা একমাত্র তা হলেই সম্ভব।
কিন্তু সে জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে হবে কংগ্রেসকেই। জি–২৩ নেতাদের নিভৃত পরামর্শও তাই।
কীভাবে? দলছুট আঞ্চলিক নেতারা কংগ্রেসে এলে রাহুল অথবা প্যালেসের মনোনীতকে নেতা হিসেবে মানবেন না। সে জন্য প্রথমেই প্রয়োজন কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে হাই কমান্ড কালচারের অবসান ঘটানো। যাঁরা ঘরে ফিরবেন (মোট সাত দল) নতুন কংগ্রেসে তাঁরাই দেবেন যৌথ নেতৃত্ব। এঁরাই নির্বাচন করবেন কংগ্রেসের সভাপতিকে। সপ্তদলীয় নেতারাই হবেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রেসিডিয়ামের সদস্য।
অমিত শক্তিধর বিজেপির মোকাবিলায় এইভাবে সবার শক্তির সমন্বয় না হলে বাঁচা কঠিন। অন্যান্য অকংগ্রেসি আঞ্চলিক দলগুলোকেও বেছে নিতে হবে তাদের পছন্দের সঙ্গী। মনে রাখতে হবে, একা একা বাঁচার দিন শেষ।
কাজটা কঠিন। এই পথে হাঁটতে গেলে অনেক স্বার্থের জলাঞ্জলি প্রয়োজন। উদ্যোগ প্রধানত কংগ্রেসকেই নিতে হবে।
রাহুল–প্রিয়াঙ্কাকে মনে রাখতে হবে, তাঁদের সামনে এখনও কুড়ি বছরের সক্রিয় রাজনীতি অপেক্ষায় আছে। ক্ষীয়মান ও হীনবল কংগ্রেসের পক্ষে দুস্তর মরু পারাপার করা সম্ভব নয়। উপর উপর কারুকাজে লাভ নেই। ফল পেতে হলে খোল নলচে বদলাতে হবে।
