
ইস্টার্ন টাইমস , নয়াদিল্লি : “বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের সমস্ত নাগরিককে দেশের বাহাত্তরতম সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক-সন্ধ্যায় আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আমাদের দেশে অনেক উৎসব পালন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সমস্ত মানুষ দেশপ্রেমের ভাবনায় জাতীয় উৎসবগুলি উদযাপন করে থাকেন|
সাধারণতন্ত্র দিবসের জাতীয় পার্বনও আমরা জাতীয় পতাকা এবং সংবিধানের প্রতি সম্মান জানিয়ে সোৎসাহে উদযাপন করি”, বলেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।
তিনি বলেন , বিশাল জনসংখ্যার এই দেশকে খাদ্য এবং দুগ্ধজাত সামগ্রী উৎপাদনে আত্মনির্ভর করে তোলার জন্য আমাদের কৃষক ভাই-বোনেদের সমস্ত দেশবাসী হৃদয়ের গভীর থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
বিরূপ প্রাকৃতিক পরিস্থিতি, অনেক সমস্যা সংকুলতা এবং কোভিড বিপর্যয় সত্ত্বেও আমাদের কৃষক ভাই-বোনেরা কৃষি উৎপাদন কম হতে দেননি। এজন্য কৃতজ্ঞ দেশ আমাদের অন্নদাতা কৃষকদের কল্যাণে পরিপূর্ণভাবে দায়বদ্ধ।
রাষ্ট্রপতি বলেন , যেভাবে আমাদের পরিশ্রমী কৃষকরা দেশের খাদ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে সফল হয়েছেন, তেমনি আমাদের সেনাবাহিনীগুলির বাহাদুর জওয়ানরা, কঠোরতম পরিস্থিতিতে, দেশের সীমান্তগুলির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে আসছেন। লাদাখের সিয়াচেন এবং গলওয়ান উপত্যকায়, মাইনাস পঞ্চাশ থেকে ষাট ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়, সবকিছু জমিয়ে দেওয়া শীত থেকে শুরু করে জয়সলমীরে, পঞ্চাশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও বেশি তাপমাত্রায়, ঝলসে দেওয়া গরমে – মাটি, আকাশ এবং বিশাল সমুদ্রউপকূলবর্তী এলাকায় – আমাদের সেনারা প্রতি মুহূর্তে ভারতের সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা, সৈন্য নিরাপত্তা, নানা বিপর্যয় ও রোগ থেকে সুরক্ষা এবং উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা তাঁদের অবদানের মাধ্যমে জাতীয় প্রচেষ্টাকে শক্তি জুগিয়েছেন।
মহাকাশ থেকে শুরু করে ফসলের ক্ষেত পর্যন্ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে হাসপাতাল পর্যন্ত, বৈজ্ঞানিক সমাজ আমাদের জীবন এবং কাজকর্মকে উন্নত করেছে। দিন-রাত পরিশ্রম করে করোনা ভাইরাসকে ডি-কোড করে অনেক কম সময়ে ভ্যাক্সিন বিকশিত করে, আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা সমগ্র মানবতার কল্যাণে একটি নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন।
দেশের মধ্যে এই অতিমারীকে বাগে আনতে, আর উন্নত দেশগুলির তুলনায় মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা, চিকিৎসকরা, প্রশাসন এবং অন্যদের সঙ্গে মিলে অপরিসীম অবদান রেখেছেন।
এভাবে আমাদের সমস্ত কৃষক, জওয়ান ও বৈজ্ঞানিকেরা বিশেষ অভিনন্দনের পাত্র।
রাষ্ট্রপতির দাবি, ভয়ানক বিপর্যয় সত্ত্বেও আমরা, অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের গতিবিধিকে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছি। এই অতিমারীর ফলে, আমাদের শিশু-কিশোর ও নবীন প্রজন্মের পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ দ্রুত নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাপ্রক্রিয়া চালু করেছেন।
বিহারের মতো ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য এবং জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের মতো দুর্গম ও প্রতিকূল এলাকায় অবাধ, নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন করানো আমাদের গণতন্ত্র এবং নির্বাচন কমিশনের প্রশংসনীয় সাফল্য।
প্রযুক্তির সাহায্যে বিচার বিভাগ সুবিচার প্রদানের প্রক্রিয়া জারি রেখেছে। এইরকম সাফল্যের তালিকা অনেক দীর্ঘ।
অর্থব্যবস্থায় সাফল্যের উদাহরণ দিয়ে রামনাথ কোবিন্দ বলেন , আর্থিক গতিবিধি চালু করার জন্য, আন-লকিং এর প্রক্রিয়া সতর্কভাবে, ধাপে ধাপে কার্যকর হয়েছে। এই প্রক্রিয়া সুফলদায়ক হয়েছে এবং অর্থ-ব্যবস্থা আরেকবার শক্তিশালী হয়ে ওঠার সংকেত দেখাতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি জিএসটি-তে রেকর্ড বৃদ্ধি আর প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় অর্থ-ব্যবস্থা হিসেবে ভারতের সাফল্য, আমাদের দ্রুত ‘অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার’ প্রক্রিয়ার সূচক। সরকার মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্পকে উৎসাহ জোগাচ্ছে; সহজ শর্তে ঋণদান করে শিল্পোদ্যোগকে উৎসাহ জুগিয়েছে এবং বাণিজ্যে উদ্ভাবনকে প্রেরণা জোগানোর জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে।
দেশের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ অর্থাৎ ২০২২-এর মধ্যে প্রতিটি গৃহহীন পরিবারকে প্রাথমিক সমস্ত সুবিধাযুক্ত পাকা ঘর তৈরি করে দেওয়া থেকে শুরু করে কৃষকদের আয়কে দ্বিগুণ করা পর্যন্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে যেতে আমরা স্বাধীনতার ৭৫তম জয়ন্তীর ঐতিহাসিক মুহূর্তে গিয়ে পৌঁছাবো।
নতুন ভারতীয় সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়ন আর নারী কল্যাণের উপরই বিশেষ জোর দিচ্ছি।
রাষ্ট্রপতি মনে করেন , আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভারত নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলা আমাদের আর্থিক সংস্কারের পরিপূরক হিসেবে নতুন আইন তৈরি করে কৃষি ও শ্রমের ক্ষেত্রে এমন সব সংস্কার করা হয়েছে, যেগুলি দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাশিত ছিল। এইসব সংস্কারের সূচনা লগ্নে উদ্বেগ তৈরি হতে পারে।
কিন্তু এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের কৃষকদের ভালোর জন্য সরকার সম্পূর্ণ রূপে সমর্পিত।
তিনি বলেন , সংস্কারগুলি নিয়ে যদি বলি, শিক্ষার ক্ষেত্রে হওয়া ব্যাপক সংস্কার উল্লেখযোগ্য। এই সংস্কার দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাশিত ছিল। এটাও কৃষি এবং শ্রমের সংস্কারের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটা আরও অনেক বেশি করে মানুষের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করবে। ২০২০ সালে ঘোষিত নতুন ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’-তে প্রযুক্তির পাশাপাশি ঐতিহ্য এবং পরম্পরাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এর মাধ্যমে এমন এক নতুন ভারতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও জ্ঞান-কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসার আকাঙ্ক্ষা রাখে। নতুন শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করবে এবং তাঁদেরকে জীবনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে সক্ষম করবে।
রাষ্ট্রপতির ভাষ্য অনুযায়ী , করোনা সংকটে প্রায় এক বছরের অপ্রত্যাশিত অগ্নি-পরীক্ষা সত্বেও ভারত হতাশ হয়নি, বরং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে উঠে এসেছে।
আমাদের দেশে আর্থিক মন্দা খুব অল্প সময়ের জন্যই ছিল।এখন আমাদের অর্থব্যবস্থা পুনরায় গতিশীল হয়ে গেছে। আত্ম-নির্ভর ভারত করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য নিজেদের টিকা তৈরি করে নিয়েছে। এখন বিশাল আয়োজনের সঙ্গে টিকাকরণের যে অভিযান চলছে, সেটা ইতিহাসে এ ধরনের সবচেয়ে বড় অভিযান হয়ে উঠবে। এই প্রকল্পকে সফল করার জন্য প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত সবাই অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন।
আজ ভারতকে সঠিক অর্থেই ‘ফার্মেসি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ বলা হচ্ছে। কারণ আমরা অনেক দেশের মানুষের কষ্ট কম করার জন্য এবং অতিমারির উপর নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার জন্য ওষুধ এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্যান্য উপকরণ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছি। এখন আমরা অন্য দেশগুলোকে টিকাও সরবরাহ করছি।
গত বছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক ধরনের প্রতিকূলতা আমাদের সামনে এসেছে। আমাদের সীমান্তে আগ্রাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের বীর সৈনিকরা সেই প্রচেষ্টা বিফল করে দিয়েছে।
এটা করতে গিয়ে আমাদের ২০ জন জওয়ান শহিদ হয়েছেন। গোটা দেশ সেই অমর জওয়ানদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা যদিও শান্তির প্রতি দায়বদ্ধতায় অটল, তবু আমাদের স্থলসেনা-বায়ুসেনা-নৌসেনা আমাদের সুরক্ষার বিরুদ্ধে হওয়া যেকোনো দুঃসাহসিক কাজকে বিফল করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতির সঙ্গে সদা সতর্ক।
যে কোন পরিস্থিতিতেই আমাদের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য আমরা সম্পূর্ণ রূপে সক্ষম। আমাদের সুদৃঢ় ও নীতিগত অবস্থান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহল বিশেষভাবে অবগত।
সংবিধানে নিহিত আদর্শকে আত্মস্থ করার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন , আমরা যেন সবসময় আমাদের সংবিধানে নিহিত আদর্শকে মূল মন্ত্র হিসেবে মনে রাখি! আমি একথা আগেও বলেছি, আর আজ আমি আবারও সেই কথা পুনরুচ্চারিত করছি, জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও চিন্তাধারা নিয়ে চর্চা করা আমাদের দিন যাপনের একটা অংশ হওয়া উচিত। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে সমাজের একজন সদস্যও দুঃখী বা অভাবগ্রস্ত না থাকেন। সাম্যই হচ্ছে আমাদের গণতন্ত্রের মহান নীতিবাক্য।
সামাজিক সাম্যের আদর্শ প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদাকে সুনিশ্চিত করে। আর্থিক সাম্যের আদর্শ, সবার জন্য সমান সুযোগ এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের সহায়তা সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্বকে সুস্পষ্ট করে। সহানুভূতির ভাবনা পরোপকারের কাজের মাধ্যমেই আরও অধিক মজবুত হয়ে থাকে।
পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের নৈতিক আদর্শই আমাদের পথ-প্রদর্শক হিসেবে আমাদের ভবিষ্যতের পথকে সুদৃঢ় করবে।
আমাদের সবাইকে সাংবিধানিক নৈতিকতার এই পথে সবসময় চলতে হবে, বাবাসাহেব ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকর সংবিধানের অবয়ব তৈরির সময় ১৯৪৮ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান সভায় নিজের ভাষণে একথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা’র অর্থ হচ্ছে, সংবিধানে নিহিত মূল্যবোধকে সবার উপরে স্থান দেওয়া।
