
তাপস দাশ
কথাটা লিখে রাখা দরকার। ইতিহাসের জন্য। সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত ইতিমধ্যেই, তবু লিথে রাখা দরকার। লিখে রাখা দরকার যে ৫০ বছরের বেশি সময়ের আগে প্রয়াত হওয়া এক শিল্পীর খোঁজে তাঁর বাড়িতে সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন দুই বিজেপি কর্মী।
গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনা ঘটেছে। অভিনেতা জহর গাঙ্গুলির বাড়িতে রক্তদানের নিমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন দুজন। রক্তদান অনুষ্ঠান প্রয়াত অটলবিহারী বাজপেয়ীর নামাঙ্কিত। আর তাঁরা গিয়েছিলেন জহর গাঙ্গুলির বাড়িতে, যিনি ১৯৬৯ সালে মারা গিয়েছেন।
খবরে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, জহর গাঙ্গুলির বাড়িতে থাকেন তাঁর নাতনি, পেশায় শিক্ষিকা সুজাতা খাস্তগীর। তিনি আমন্ত্রণকারী দুজনের সঙ্গে কথা বলেন, বিষয়টি জানেন, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানাননি জহর গাঙ্গুলির প্রয়াণের কথা। তিনি জানিয়েছেন আমন্ত্রণকারীরা হিন্দি টানে বাংলা বলছিলেন।
এই তথ্যের সঙ্গে মনে করার, শান্তিনিকেতনে অমর্ত্য সেনের জমি দখল করার একটা চক্রান্ত শুরু হয়েছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যার আচার্য প্রধান সেবক নরেন্দ্র মোদী, এর পিছনে রয়েছে। অমর্ত্য সেন দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপির প্রখর সমালোচক। তার জেরে অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে সীমাহীন বিষোদগার করতে আটকায়নি বিজেপি ক্যাডারদের। তাঁর বিবাহ, বিবাহভঙ্গ থেকে শুরু করে তাঁর বিদেশবাস, কোনও কিছু নিয়েই চর্চা করতে বাধেনি এই অতিদক্ষিণপন্থী না-লায়েকদের।
বাম-কংগ্রেস ভোটের জোট : ইতিহাস ও ভূগোল: তাপস দাশ >>
একই ঘটনা ঘটেছে অভিজিৎ বিনায়কের ক্ষেত্রেও। তিনি কোন বিদেশিনী বিবাহ করেছেন, প্রথম বিবাহ কেন টেঁকেনি, এ সব আলোচ্যসূচিতে নিয়ে আসতে বিন্দুমাত্র আটকায়নি গেরুয়ারঙা সোশাল মিডিয়াসন্ত্রাসীদের। এ ধরনের ঘটনা বাংলায় সম্প্রতি শুরু হয়েছে। গোবলয়ের সংস্কৃতিটিকে ক্রমশ আমদানি করতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি।
অবশ্য একে কেবল গোবলয় সংস্কৃতি বলে আর চিহ্নিত করা যায় কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। গোবলয়ের সংস্কৃতিকে একমাত্র ও ভারতীয় সংস্কৃতি বলে চালানোর একটা প্রক্রিয়া চলছে। যে প্রক্রিয়া শক্তিশালী ও সচেতন।
জহর গাঙ্গুলির বাড়িতে যাওয়া প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসুর সাফাইটিকে একবার খেয়াল করা যাক। তাঁর যে কথাটুকু বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম উদ্ধৃত করেছে, তার শেষ বাক্যটি হল, “তবে আমরা কিন্তু বাংলার শিল্প, সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।”
“তবে” এবং “কিন্তু” শব্দদুটি লক্ষণীয়। এই শব্দদ্বয় তাঁদের জাত চিনিয়ে দিতে সক্ষম। বাংলার শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁদের তবে ও কিন্তুর আশ্রয় নিতে হয়। নিতে হয়, কারণ আসলে এ সবে তাঁদের কিছু এসে যায় না। বিজেপি বাংলার সংস্কৃতি ও শিল্প বোঝে না। কারণ বিজেপি ফেডেরালিজমের ধার ধারে না।
তার এক অখণ্ড ভারত চায়, যে ভারত, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানিদের ভারত।
সেখানে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির অবকাশ নেই।
জহর গাঙ্গুলির বাড়িতে কার্ড দিতে যাওয়ার ঘটনার মধ্যে যে হাসির খোরাক রয়েছে, তাকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা চলে না। এ ঘটনা আরেকবার প্রমাণ করে দেয় যে বিজেপি বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি তথা শিল্পীদের কতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে।
দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপি বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিজগতে নিজেদের পা ফেলতে চাইছে। এখনও যে তারা সক্ষম হয়নি, তার একটা বড় কারণ, এই দলটির বাংলা সম্পর্কে জ্ঞানহীনতা।
একাধিকবার তারা লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সমাগম ঘটানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রত্যক্ষত তেমন সফল হয়নি। বছর দুয়েক আগে এরকম এক সভায় কেবল টিমটিম করেছিলেন একদা জনপ্রিয় এক জঙ্গলকাহিনিকার।
কিন্তু বিজেপি হাল ছাড়ার পাত্র নয়। বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন স্তরে লোভ দেখানোর প্রক্রিয়া তারা জারি রেখেছে। সে লোভ অর্থের ও ক্ষমতার।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির লেখক-শিল্পীদের পক্ষে ভেড়ানোর প্রক্রিয়া হিসেবে তা একেবারে কার্যকরী হয়নি, এমন নয়।
কিন্তু প্রতিরোধীদের সংখ্যা এখনও বেশি। সে সংখ্যা বিজেপির প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে যে কমবে, সে নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
টেলিভিশন মিডিয়ার শিল্পী ও কলাকুশলীদের মধ্যে এ ব্যাপারে তারা কিছুটা সফলও হয়েছে।
অখণ্ড ভারতীয় সংস্কৃতির পক্ষে সওয়াল করার জন্য বাংলা ভাষার কিছু বুদ্ধিজীবী যে পা বাড়িয়ে রয়েছেন, এমন কানাঘুষো ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল তাঁদের সে বাড়ানো পা কতটা এগিয়ে যাবে নাকি পিছিয়ে আসবে, তা সময়ই বলবে।
সে কারণেই, যে কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেই কথাটাই ফের একবার উচ্চারণের। জহর গাঙ্গুলির কথাটা লিখে রাখবার। ইতিহাসের জন্য। অপমানের জন্য।
